জন্মের পর যত্নের সাথে মায়ের কাছে তার শ্রেষ্ঠ উপহার সন্তানকে তুলে দিয়েছেন। এক, দুই বা তিন বছর নয়, ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে ৩ সহস্রাধিক সন্তান প্রসবের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। পরম মমতাভরে মায়ের আদরে কোলে তুলে নিয়েছেন নবজাতকদের। এমনই একজন ধাত্রী খুলনার রাশিদা বেগম।
খুলনার খালিশপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ধাত্রী হিসেবে সুনাম রয়েছে তার। মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠার পাশাপাশি অর্থ উপার্জন করে সংসারের হাল ধরেন তিনি। উপার্জিত অর্থ দিয়ে ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ ও বিয়ে দিয়েছেন তিনি। এখন বয়সের ভারে নূয়ে পড়েছেন তিনি। সম্প্রতি ৭৫ বছর বয়সী এই সংগ্রামী নারী রাশিদা বেগম ব্রেন স্টোক করে পড়ে রয়েছেন খুলনার খালিশপুর এলাকার ভাড়া বাড়িতে।
ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না। অনেককিছু ভুলতে বসেছেন। যাকে দেখেন তাকে জড়িয়ে আপনজন ভেবে কেঁদে ফেলেন। আজ নারী দিবসে এমন একজন সংগ্রামী নারীর জীবনযুদ্ধের কথা শুনবো।
প্রসূতি গাইনী (ধাত্রী) সংগ্রামী নারী রাশিদা বেগম বলেন, আমার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। আমি প্রায় ৩০ বছর ধরে সন্তান ডেলিভারীর কাজ করি। স্বামী রিক্সা চালক ছিলেন। তার আয়ে সংসার চলতো না। সে জন্য আমি প্রথমে গির্জায় কাজ শুরু করি। সেখানে ডেলিভারীর কাজ করতে করতে বাড়িতে বাড়িতে যেয়ে ডেলিভারীর কাজ করি। এরপর আমাকে ব্রাকে চাকরি দেওয়া হয়। খুলনা, যশোরসহ বিভিন্ন এলাকায় কাজ করেছি। আমাকে ছাড়া কেউ ডেলিভারীর কাজ করাতো না। একটা দুইটা নয়, হাজার হাজার বাচ্চা হয়েছে আমার হাতে। তারা ভালোই আছে। কিন্তু এখন আর পারি না। নিজেই অসুস্থ। অনেকেই আমাকে দেখতে আসে। খুব ভালো লাগে।
রাশিদা বেগমের বড় মেয়ে হামিদা বেগম বলেন, মা আমার বিয়ের আগে থেকেই ধাত্রীর কাজ করতো। প্রথমে গির্জায় শিক্ষা নিয়েছে, এরপর বাসায় বাসায় যেয়ে ডেলিভারীর কাজ করতো। এমার্জেন্সি রোগি হলে ক্লিনিকে নিতো। পরবর্তীতে ব্রাকে চাকরী নেয়। ব্রেন স্ট্রোক করার পর সেখান থেকে চাকরী চলে যায়। এখন আমার মা অচল, বিছানায় পড়া।
তিনি বলেন, আমার মা ৩০ বছর এই ধাত্রীর কাজ করেছেন। এই সময়ে ২-৩ হাজারের বেশি বাচ্চা প্রসবের কাজ করেছে। খুলনা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা পর্যন্ত যেয়ে এই কাজ করেছেন। মাঝে মধ্যে আমার মাকে খুঁজতে যেতে হতো। দুই তিনদিন সে এই কাজে থাকতেন। সেই সময়তো আর মোবাইল ছিল না, যে জানবো কোথায় আছে। সে জন্য খোঁজাখুজি করতাম। এই কাজ করেই আমাদের সংসার চলতো। বাবা রিক্সা চালাতো, তেমন আয় ছিল না। আমার মা এই কাজ করে আমাদের মানুষ করছে, বিয়ে দিয়েছে। বাবা মারা যাওয়ার পরেও মা ব্রাকে চাকরী করতেন। তবে অসুস্থ হলে তিন-চার বছর হলো আর কাজ করতে পারেন না। এখন আমি, আমার বোন ও ভাই তার দেখভাল করি। এছাড়া যারা আমার মায়ের হাতে জন্ম নিয়েছে এমন অনেকেই আর্থিক সহযোগিতা করেন। একজন মাসে দুই হাজার টাকা করে দেন, বাকীটা আমরা দেখি।
খালিশপুর বঙ্গবাসী স্কুলের পশ্চিম পাশের বাসিন্দা নিঘাত সীমা বলেন, ধাত্রী হিসেবে রাশিদা বেগমের ব্যাপক পরিচিতি এবং এলাকায় তার সুনাম রয়েছে। বিশেষ করে আমাদের পারিবারের সন্তান হওয়ার সময়ে তিনি খুব সুন্দরভাবে নিজের সন্তানের মতো করে পরিচর্যা ও সেবা দিতেন। নিয়মিত আসা, সেবা করা, বাচ্চা কেমন আছে সেই খোঁজ খবর নিজে থেকেই নিতো। একজন চিকিৎসকের মতোই তিনি আমাদের খেয়াল রাখতো। আমরাও তাকেই রাখতাম। আমার সন্তন, আমার ভাই ও বোনের সন্তানসহ পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনের সন্তানদেও জন্মের সময়ে তিনি ধাত্রী হিসেবে কাজ করেছেন। তার হাত ধরেই আমাদের বাচ্চাদের জন্মদান। তিনি যথেষ্ঠ শ্রম দিতেন, সারারাত বাড়ি যেতেন না। অনেকেই আছে দেখলাম, আসলাম, চলে গেলাম। কিন্তু তিনি সেরকম নয়। আমরা যন্ত্রণায় ছটফট করেছি, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি পেরেছেন সাহায্য করছেন, সাথে ছিলেন, সবকিছুই উনি করেছেন। ধাত্রী হিসেবে বাড়ি বাড়ি যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ক্লিনিক ও ব্রাকেও কাজ করেছেন। তার অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। তার হাত দিয়ে অনেক সন্তান জন্ম হয়েছে। অনেকে বড় হয়েছে, ভালো আছে।
তিনি বলেন, এখন তার বয়স ৭৫ থেকে ৮০ বছর হবে। পারিবারিক অবস্থাও তেমন একটা ভালো না। এখন তার যে দূরাবস্থা রয়েছে তাতে তার পাশে আমাদের দাড়ানো উচিত। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা ও সহযোগিতায় সকলের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
খুলনা গেজেট/এএ