সুন্দরবনের হরিণ শিকার উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। চলতি সপ্তাহে চোরা শিকারিদের কাছ থেকে হরিণের মাংস ও চামড়া উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ সময় শিকারি চক্রের কয়েকজনকে আটকও করে পুলিশ। পরে তাঁদের বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী নিধন আইনে মামলা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জানুয়ারি মাসে খুলনা ও বাগেরহাট সীমান্তে করা তিনটি পৃথক অভিযানে সাতজন শিকারি চক্রের সদস্য গ্রেপ্তার করে সুন্দরবন থেকে শিকার করে আনা হরিণের প্রায় ১৬ কেজি মাংস ও ১৯টি চামড়া উদ্ধার করেছে পুলিশ।
স্থানীয় কয়েকটি সূত্রমতে, সুন্দরবন ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে পেশাদার হরিণ শিকারিদের আছে বিশেষ সিন্ডিকেট এবং তাঁদের সঙ্গে থাকে এজেন্ট ব্যবসায়ীরা। এসব এজেন্টের মাধ্যমে কখনো অগ্রিম অর্ডার আবার কখনো মাংস এনে তারপর বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করা হয়। আগের মতো আবারও বেড়েছে সুন্দরবনে হরিণ শিকার।
দাকোপ উপজেলার বাণীশান্তা গ্রামের বাসিন্দা আবেদ খান খুলনা গেজেটকে জানান, ‘বনবিভাগের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের খুশি করতে ও তদবির হিসেবেও হরিণের মাংস সরবরাহ করে থাকে শিকারিরা। এসব কারণেই প্রধানত লোকালয়ের অনেক লোকই হরিণ শিকারকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।’ তিনি আরও জানান, ‘শিকারিদেরকে বনবিভাগের লোকজন চেনেন, কিন্তু তাদেরকে কখনো গ্রেপ্তার করে না।’
শুক্রবার (২২ জানুয়ারি) দিবাগত রাত পৌনে দুইটার দিকে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলা সদরের ব্র্যাক অফিসের সামনে থেকে সুন্দরবন থেকে শিকার করে আনা হরিণের ১৯টি চামড়াসহ দুই পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করে জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন, শরণখোলা উপজেলার রাজৈর গ্রামের মো. মতিন হাওলাদারের ছেলে মো. ইলিয়াস হাওলাদার(৩৫) এবং একই উপজেলার ভদ্রপাড়া গ্রামের মো. মোশারেফ শেখের ছেলে মো. মনিরুল ইসলাম শেখ(৪৫)। গ্রেপ্তারের পরেদিন বিকেলে তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠান পুলিশ।
বন বিভাগের মতে, বন ডাকাতরা এখন তুলনামূলকভাবে কম সক্রিয়, কিন্তু হরিণ শিকারিদের চক্রগুলোর উৎপাত সুন্দরবন ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আবার বেড়েছে। তবে হরিণ নিধন এবং শিকারের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে সোমবার (২৫ জানুয়ারি) দিবাগত রাত একটার দিকে খুলনার দাকোপ উপজেলার পানখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে স্থানীয় মাসুদের দোকানের সামনে রাস্তার ওপর সুন্দরবন থেকে শিকার করে আনা হরিণের ১১ কেজি মাংসসহ দুইজনকে গ্রেপ্তার করে থানা পুলিশ। এর আগে গত রোববার উপজেলার কৈলাশগঞ্জ ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের ধোপাদী গেটের পাশে গভীর রাতে অভিযান চালিয়ে ওই গ্রামের পাকা রাস্তার ওপর থেকে হাতেনাতে সাড়ে চার কেজি হরিণের মাংসসহ তিন পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন, খুলনার খানজাহান আলী থানার আটরা পালপাড়া এলাকার খান গোলজার আহম্মেদের ছেলে খান মুজিবুল সুলতান(৩৩) ও একই থানার মসিয়ালী পশ্চিমপাড়া এলাকার আয়নাল ফকিরের ছেলে মো. টিটু হোসেন(২৪) এবং চট্টগ্রামের জোয়ারগঞ্জ (পুরাতন মিরসরাই) থানার বরাইয়া গ্রামের মৃত মুন্সি মোস্তফার ছেলে রুহুল আমিন ভুইয়া, রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর থানার ইসলামপুর গ্রামের মৃত আলী আকবর হাওলাদারের ছেলে আব্দুস সোবাহান(৬৫) ও দাকোপ উপজেলার কৈলাশগঞ্জ ইউনিয়নের রামনগর উত্তরপাড়া গ্রামের মৃত জিতেন্দ্রনাথ রায়ের ছেলে কুমারেশ রায়(৫৫)।
থানা সূত্রে জানা গেছে, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে পাচারকারীদের আটক করে পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে কালো রঙের ব্যাগের ভেতর পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় হরিণের মাংস উদ্ধার করা হয়। পরে তাদের বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী নিধন আইনে মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু কোথাও এই শিকারি চক্রের মূল হোতাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি।
‘দাকোপ উপজেলার অনেক গ্রামে হরিণের মাংস নিয়মিত বিক্রি হচ্ছে এবং যতদিন যাচ্ছে, এই প্রবণতা বেড়েই চলছে। অনেকেই ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে খুশি মনে হরিণের মাংস কিনছে বলে জানান স্থানীয়রা।’
দাকোপ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. সেকেন্দার আলী খুলনা গেজেটকে বলেন, ‘হরিণ শিকার ও পাচাররোধে তাঁরা সব সময় সতর্ক রয়েছেন। বিভিন্ন সময় তাঁরা অভিযান চালিয়ে হরিণের মাংসসহ পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করেছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগের তুলনায় হরিণ শিকার অনেকটাই কমে এসেছে। তবে এটি জিরোটলারেন্সে নেওয়ার চেষ্টা চলছে।’ সুন্দরবন থেকে হরিণ শিকারের মূল হোতাদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান অব্যাহত রেখেছেন বলে জানান ওসি।
অন্যদিকে, স্থানীয়রা জানায়, কর্তৃপক্ষের কাছে চিহ্নিত হরিণ শিকারি এবং মাংস ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা থাকার পরেও প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনোরকম ব্যবস্থাই গ্রহণ করছে না। উল্টো, বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের বেশ কিছু কর্মচারীর সঙ্গে এসব শিকারি চক্রের যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে।
জানতে চাইলে বাগেরহাটের পুলিশ সুপার (এসপি) পংকজ চন্দ্র রায় মুঠোফোনে খুলনা গেজেটকে বলেন, ‘এর আগে একসঙ্গে এতগুলো হরিণের চামড়া কখনো উদ্ধার হয়নি। গত শুক্রবারের ওটাই হল হরিণের চামড়ার সবচেয়ে বড় চালান।’ তিনি আরও বলেন, ‘চামড়াসহ পাচারকারীদের গ্রেপ্তারের পর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। পরে আদালতে তাদের বিরুদ্ধে রিমান্ডমঞ্জুর হলে জিজ্ঞাসাবাদে নিয়ে হরিণ শিকারের ফাঁদ জব্দ করা হয়েছে।’
এসপি বলেন, ‘গ্রেপ্তার ওই দুজন চিহ্নিত পাচারকারী। এই চক্রের সঙ্গে আরও কারা জড়িত আছেন, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তবে এ ঘটনায় ওই দুজন বাদে এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। সুন্দরবনের প্রাণী ও বনজ সম্পদ রক্ষায় পুলিশ তৎপর রয়েছে। বন রক্ষায় ও ওই চক্রের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশের অভিযান অব্যাহত থাকবে।’
খুলনা গেজেট / এআর / টিআই