বিকালের সূর্য এখনো পশ্চিমে ঢলে পড়েনি। রোদের তাপটাও খুব একটা নেই এখন। শীতকালটা এদিক দিয়ে বড্ড বেশী আরামের। অতিরিক্ত তাপ শরীরে ঘামের সৃষ্টি করে যা প্রচন্ডরকম অস্বস্তিকর। প্রত্যেকদিন শার্ট, প্যান্ট ধুয়ে দিতে গেলেও বেশ সময়ের অপচয় হয়, শরীরের ক্যালোরি নষ্ট হয়। ব্যাচেলরদের শীতকাল স্বর্গীয় অনুভুতি দেয়। বিধুবাবু আজীবন ব্যাচেলর। বিয়ে করার সময় তার আর হয়ে ওঠে নি। নিজের সমস্ত কাজ বেচারার নিজেকেই করতে হয়। বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি অথচ তাকে দেখে তা অনুমার করার উপায় নেই। বিধুবাবুর ঘরটা খুব চমৎকার না হলেও পরিপাটি। ঘরের তিন দিকে ব্যালকনি। পুবের আকাশে সকালের সূর্য আর পশ্চিমের আকাশের সূর্যাস্ত, রক্তিমাভ গোধুলি-সবই দেখার উপযুক্ত বন্দোবস্ত করে রেখেছেন তিনি। সামনের উঠোনজুড়ে ফুলের বাগান। হরেক রকম ফুল সেখানে। বিধুবাবু চেয়ার টেনে বসলেন পশ্চিমের বারান্দায়, হাতে তার তখন ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা।
বিধুবাবুর কোন নেশা ছিল না বললেই চলে। তবে যা করেন তা হল, দিনের মধ্যে গোটা সাত আট কাপ চা পান করেন, সবগুলোতেই দু চামচ চিনি দিয়ে। পশ্চিমের আকাশ থেকে উবে যাচ্ছে গনগনে সূর্যটা। বিধুবাবু বেশ মনোযোগ সহকারে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন গোধুলি দেখার লোভে।
প্রত্যেক জীবনে এরকম সূর্যোদয় ঘটে ঘটা করে। ক্ষুধার্ত কাক প্রথম সকাল শুরু করে। তারপর জীবন ক্রমান্বয়ে ছুটে চলে ক্ষুধা নিবারনের চেষ্টায়। একসময় শরীর জুড়ে নতুনত্ব আসে, গনগনে আগুনের মধ্যাহ্নের মত ভেতরে প্রেম জাগে। কেউ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়, কেউ প্রণয় আর বিরহ নিয়ে গোটা জীবনটা কাটিয়ে দেয়। তারপর আসে পশ্চিমের আকাশে ঢলে পড়া সূর্যের মত বার্ধক্য। শক্ত, সমর্থ শরীর এক নিমিষে নুয়ে পড়তে চায় লতাগুল্মের ন্যায়। তারপর কখন যেন রাত আসে, বড় তাড়াতাড়িই আসে। অনেক কাজ ততদিনে বাকি থেকে যায়। তবু রাত হয়, এক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে নিয়ম করে।
বিধুবাবু খুব একটা পত্রিকা পড়েন না। পত্রিকা পড়তে তার নাকি বিরক্ত লাগে। যতরাজ্যের অযৌক্তিক খবর দিয়ে পত্রিকার পৃষ্ঠা ভরানো বলেই তার ধারনা। অথচ ঐ পত্রিকা অফিস-ই যে একসময় তার প্রাণ ছিল তা বোধ করি খুব অল্প মানুষ ই জানে। বিধুবাবু আমার সময়েরই মানুষ। খুব কাছে থেকে দেখেছি বলে আমিও জানি তার পত্রিকা নিয়ে এত ফাঁপা আওয়াজ কেন? সে কথা বহু আগের, ওগুলো পরে বলা যাবে। বিধুবাবু এর মধ্যে চা শেষ করে ফেলেছেন। রিটায়ারমেন্টের এই এক অসুবিধা। সময় যেন কিছুতেই কাটতে চায় না। বিধুবাবু খুব দ্রুত চা শেষ করলেন। পশ্চিমের আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে নিলেন। গোধুলি তখন শেষ লগ্নে। পাখিরা আপন গৃহে ফিরে যাওয়ার জন্য ডানা ঝটপট করে উড়তে শুরু করেছে। বিধুবাবু সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলেন, গায়ে জড়ালেন পরিচিত শালটা। বছর পঁচিশেক আগে এই পাঞ্জাবি আর শালে বহু রমনীকে ভুলিয়েছেন তিনি। বাগান থেকে গোঁটা পাঁচ- ছয় গোলাপ আর রজনীগন্ধা ছিঁড়ে হাতে নিলেন। আঙুলের মাথায় একফোঁটা রক্ত সাদা রজনীগন্ধাকে ও লাল করে দিয়েছে। বিধুবাবু উঠোন ছাড়িয়ে গেট খুলে রাস্তায় নামলেন। চারপাশে যেন সৌন্দর্যের মেলা বসেছে।
পৃথিবীতে এত সমস্ত সৌন্দর্য অনাবিষ্কৃত থেকে যাবে অদক্ষ প্রেমিকের কাছে। তার জানাই হবে না কালো চুলে সাদা বেলীর ঘ্রাণ কেমন! তার কখনো শোনা হবে না প্রেমিকার বুকের উষ্ণ রক্তস্রোত, দ্রুত প্রতিধ্বনিত হওয়া হৃদপিন্ডের গরম নিঃশ্বাসের শব্দ।
বিধুবাবুর আজ শরীরজুড়ে বয়স নেমেছে কিন্তু মনে তার বিন্দুমাত্র ছাপ পড়ে নি। একজোড়া কপোত কপোতী সরু গলিটার মুখে দাঁড়িয়ে আছে ঘনিষ্ঠভাবে। প্রেমিকের চাহনীতে প্রচন্ড রকম চাওয়া আর প্রেমিকার চোখে লুকিয়ে আছে ভয়, সংকোচ, লজ্জা, সংস্কার। মেয়েটি পরেছে লাল রঙের পাড় বাঁধানো একটা শাড়ি। খোপায় কৃত্রিম বেলী ফুল। ছেলেটি পরেছে সাদা পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা। সাদা আর লালে মিশে দুজনকে মানাচ্ছে বেশ। হয়ত পরিকল্পনা করেই আজ সেজে বেরিয়েছে দুজনে।
বিধুবাবু হাঁটতে হাঁটতে আনমনে কখন যেন ফিরে গেলেন তেইশ বছর বয়সে। তখনও পড়ালেখা শেষ হয় নি তার। রাস্তার মোড়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া, চা খাওয়া, দু একটা মেয়ে দেখে হাসি ঠাট্টা করাই তার একমাত্র কাজ। যদিও তখন তিনি বিধুবাবু হয়ে ওঠেন নি। বিধু, বুধো বলেই পরিচিত মহলে নামডাক ছিল তার। তবে রেজাল্টের কথা বললে তাকে সবসময় এগিয়ে রাখতেই হবে। বলতেই হবে মাথা ছিল তার। শেষ বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে তিনি তার ফাইলটা হারিয়ে ফেললেন। তার মধ্যে মূল্যবান জিনিসের মধ্যে অ্যাডমিট কার্ড, রেজিস্ট্রেশন কার্ড ছিল। অনেক খোঁজাখুঁজির করার পর যখন পাওয়া গেল না তখন সুমন বলল, পত্রিকা অফিসে একটা বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য। বিধুবাবুর তখন যাচ্ছে না তাই অবস্থা। যে যা বলছে তাই করছে। সুমন বিষয়টা বুঝতে পেরে বলল, “খরচাপাতির বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না বিধু, ও আমিই দেখব। আমার মাসতুতো বোন একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে।” বিধুবাবু সম্মত হতে দেরী করলেন না। পরদিন ই তারা দুজনে একসাথে গেলেন পত্রিকা অফিসে। রিপোর্টিং ডেস্কে এক সুন্দরী মেয়েকে দেখিয়ে সুমন বলল,”আমার বোন শ্রীময়ী।” বিধুবাবু ছোট্ট নমষ্কার করে তার সমস্যার বিবরণটা দিলেন। তারপর খোঁজখবর নেওয়ার জন্য প্রায় প্রতিদিনই বিধুবাবু এসে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতেন শ্রীময়ীর ডেস্কের সামনে। কোন কথা না হলেও নীরবে অনেক কথা হত তাদের। অ্যাডমিট, রেজিষ্ট্রেশন মিলেছিল কাগজে ছাপানোর দুদিন পরেই। কিন্তু পত্রিকা অফিসের প্রয়োজন ফুরায় নি বিধুবাবুর। দিনে অন্তত একবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য সেখানে ঢুকে ঘন্টা পার করে দিয়ে আসতেন শ্রীময়ীর টেবিলের সামনে বসে। এভাবে কয়েক মাস চলল। তাদের মধ্যে সম্পর্কের কোন বন্ধন তৈরী হয়েছিল কি না তা এক উপরওয়ালাই জানেন। শ্রীময়ী একদিন বিধুবাবুকে ডেকে বললেন,”আমার মনে হয় আপনি এখানে শুধুই কৃতজ্ঞতা দেখাতে আসেন না। কৃতজ্ঞতা প্রতিদিন দেখানোর বা শোনানোর জিনিস না। আপনি আসলে কি বলতে চান?” বিধুবাবু খানিকটা থতমত খেতে খেতে বললেন,”না না আর কি, শুধু এজন্যই।”
-তাহলে আপনি আর আসবেন না এখানে।
বিধুবাবু মাথা নিচু করে উঠে চলে গিয়েছিলেন। অব্যক্ত ভালবাসা কিছু চাপা কষ্টের কাছে শেষ অবধি হার মানতে বাধ্য হয়। বিধুবাবু পত্রিকা অফিস যাওয়া ছেড়ে দিলেন। কিন্তু মোড় ছাড়লেন না। চা খেতে খেতে একবার অন্তত দেখে নিতে চাইতেন শ্রীময়ীর মুখটা। কে জানে, আড়চোখে সে ও কখনো বিধুবাবুকে দেখত কি না।
মাসখানেক পরের কথা। বিধুবাবু ততদিনে চায়ের দোকানটাও ছেড়ে এসেছে। শ্রীময়ীর সাথে দীর্ঘদিন তার দেখা হয় নি। পত্রিকা অফিসে সে আসে না বহুদিন হল। সুমনের কাছ থেকে দিব্যি জেনে নেওয়া যেত শ্রীময়ীর কথা। কিন্তু লজ্জার কথা হল, সুমনকে সে একথা কখনোই বলতে পারবে না। সুমন একদিন রাত দশটা নাগাদ বিধুবাবুর বাড়ি এসে তাকে ডেকে তুলে বলল,”একটু তোকে যেতে হবে আমার সঙ্গে, শ্রীময়ী তোর সাথে দেখা করতে চায়।”একলাফে উঠে পড়লেন বিধুবাবু। কোন প্রশ্ন করলেন না সুমনকে। চুলটাও ঠিকঠাক না আঁচড়িয়ে সুমনের অনুসরন করলেন। সুমনের মুখটা ভার হয়ে আছে দেখে তিনি বললেন,”কি রে, কি হয়েছে তোর? এত রাতে?” সুমন বলল,”বাড়ি চল,সব জানতে পারবি।”
সারারাস্তায় আর কোন কথা হয়নি দুজনের।
শ্রীময়ী বিছানায় শুয়ে আছে। লাবন্যের প্রাচুর্যে ভরা মুখটাতে শুধু অন্ধকার লেপ্টে আছে এখন। পাশে একজন ডাক্তার কানে স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে কি সব দেখছেন যেন। নার্স দুজন পাশে এটা ওটা নিয়ে ব্যস্ত। শ্রীময়ী বললেন,” অন্তত একটা ফুল নিয়ে আসতে পারতে!”আজ আমার ভালবাসা দিবস। প্রথম প্রেম জাহির করার দিন। অথচ সবাই দেখো, মুখ কালো করে রেখেছে। এভাবে কাউকে ভাল লাগে বল? আচ্ছা, তুমি আমাকে কি বলে ভালবাসা জানাবে? আমি কিন্তু তোমাকে প্রথমেই ভালবাসি বলব না। শুধু পত্রিকার অফিসের সামনে দিয়ে তুমি হাঁটতে না বিধুবাবু, তুমি হাঁটতে আমার ভেতরজুড়ে। তোমাকে যখন দেখতাম তখন বুকটা ধুকধুক করে উঠত। মনে হত, এই তুমি এসে বলবে- আজ ওঠে তো, চলো কোথাও থেকে ঘুরে আসি।”
বরাবর নিশ্চুপ থাকা মেয়েটা যখন অজস্র কথা বলে তখন আশপাশের সবাই চমকে যায়। বিধুবাবুও স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। অথচ অনেক কথা তার জমানো, অনেক কথাই বের হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলছে। ডাক্তার মহোদয়কে পাশে ডেকে বিধুবাবু শুনেছিলেন শ্রীময়ীর অবস্থাটা। গত তিনবছর ধরে একটানা নিয়মমাফিক ব্লাড পরিবর্তন করা হচ্ছে তার। এবারের রক্তটা শরীর নিতে পারছে না। মাসখানেক ধরে মৃত্যুযন্ত্রনায় ছটফট করছে সে। শ্রীময়ী ডেকে বললেন,”এইটুকু সময় এসেই সব জেনে ফেললে বিধুবাবু। এসে, একটু পাশে বসো তো।” হাতের শিরায় তখন সুঁচ ফোটানো স্যালাইনের। বিধুবাবু আঙুলগুলো আলতো করে হাতের মধ্যে পুরে নিলেন। শ্রীময়ী একদৃষ্টে বিধুবাবুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। এভাবে সে কখনো দেখে নি কাউকে। এই তাকানোতে থেকে যাওয়ার লোভ থাকে, মৃত্যুভয় বাড়ে। শ্রীময়ী বলল,”আজ বড় বাঁচতে ইচ্ছে হচ্ছে জানো?”বিধুবাবু বলল,”তোমার কিছুই হবে না দেখো, এ খুব সামান্যই অসুখ। অল্প ওষুধেই সেরে যাবে।” মুচকি হাসি হাসল শ্রীময়ী। বলল,”তুমি অন্তত স্বান্তনা দিও না।” কথাটার শেষ হল কি হল না, মুখের হাসিটা মিলিয়ে যায় নি তখনো। শ্রীময়ীর চোখজোড়া বন্ধ হয়ে গেল আপনিই, একবার মাত্র কেঁপে উঠল শরীরটা। বিধুবাবু তখন ও হাত ধরে বসে রইলেন।
ডাক্তার এসে নাড়ী টিপে বললেন,”শ্রীময়ী নেই।” যদিও এটা কাউকে আর বলার প্রয়োজন ছিল না। একরাশ গুমোট নিস্তব্ধতা বারবার বলে দিচ্ছিল, সে আর নেই। পত্রিকা অফিসের দরকার ফুরিয়েছে চিরতরে।
তখন বারোটা বেজে এক মিনিট।হাঁটতে হাঁটতে এক পুরনো শ্মশানের কাছে এসে থামলেন বিধুবাবু। হাত দিয়ে চুইয়ে পড়া রক্ত সাদা রজনীগন্ধাকে লাল জবার মত করে তুলেছে। আজ সাতাশ বছর এভাবে ফুল দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। শ্মশানের পাশে বেড়ে ওঠা আগাছাগুলো বাতাসের ঝাপটায় নড়েচড়ে উঠছে বারবার। বিধুবাবু শ্মশানের কাছটায় বসে পড়লেন।এক হাতে ফুল তুলে দিলেন শ্মশানের বুকে। অস্ফুট স্বরে বললেন,” আমাদের ভালবাসা আমৃত্যু অমলিন থাকবে প্রিয়মতা। ভালবাসা নিও। ” চারপাশের বাতাস কেঁপে কেঁপে উঠল একবারের জন্য।
বিধুবাবু উঠে দাঁড়ালেন ফিরে যাওয়ার জন্য।খানিকটা পথ এগিয়ে গেলেন তিনি।পিছন থেকে এবারও একটা শব্দ ভেসে আসল,”ভোর হতে এখনও কিছু সময় বাকি বিধুবাবু, তুমি কি আমার বুকে আর কিছু সময় মাথা দিয়ে শুয়ে থাকতে পারতে না!”
বিধুবাবু হাঁটছেন,রাস্তায় রাস্তায় পুবের আলো ফুটেছে ততক্ষণে।
খুলনা গেজেট/কেএম