দর্শনশাস্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নন্দনতত্ত্ব। নন্দনতত্ত্ব মূলত সৌন্দর্যচেতনা বা সৌন্দযর্ তত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠা করেছে। মানবজাতির সৃষ্টি রহস্য সুন্দরের পূজারী। সত্যই-সুন্দর। সুন্দর-ই সত্য। জন কিটস-এর শাশ্বত উচ্চারণ ‘Beauty is truth, truth is beauty.’ সত্য ও সুন্দরের মাঝে তাই সূক্ষ্মতম সৌন্দর্যের অবিনশ্বর বন্ধন বিদ্যমান। কীটস-এর মতো হিন্দুধর্মানুসারীগণ একটি উক্তিকে ধর্মোপসনা মনে করেন। উক্তিটি সংক্ষিপ্ত। সেটি হচ্ছে ’সত্যম-শিবম-সুন্দরম।’ এখানেও সেই সত্য ও সুন্দরের মেলবন্ধন।
মুসলিম ধর্মানুসারীগণ আল্লাহর উপাসনা করেন। সেখানেও একটি প্রজ্জ্বোল উক্তি রয়েছে-’আল্লাহ নিজে সুন্দর এবং সুন্দরকে পছন্দ করেন।’ সবকিছু একই বিন্দুতে মিলিত হয়। সেই শাশ্বত শান্তির বিন্দুটি হচ্ছে সত্য-সুন্দর। অর্থাৎ সত্যের একটি সৌন্দর্য রয়েছে। অপরপক্ষে সৌন্দের্যে অন্তর্নিহিত আছে সত্য। এই সত্য ও সুন্দরের বিষয় বিধৃত হয়েছে সৌন্দর্যতত্ত্বে। নন্দনতত্ত্বই কার্যত সৌন্দযতত্ত্ব হিসেবে পরিচিত। দর্শনশাস্ত্রের গুরুত্ব এখানেই। গবেষণা বা দর্শন সবসময় সত্যের অনুসন্ধান করে। তাছাউফ চর্চার মাধ্যমে এককসত্ত্বার সত্য অনুসন্ধান দর্শনে সুফিবাদ নামে পরিচিত। সুতরাং সুফিবাদ/সুফিদর্শন নন্দনতত্ত্বের আকর। সুফিদর্শনকে কাব্য সাহিত্যে প্রকাশ করেছেন অনেক কবি সাহিত্যিক। মৌলানা জালালউদ্দীন রুমি, হাফিজ, ওমর খৈয়ামের মতো পারস্য কবি যেমন রয়েছেন, তেমনি ভারতীয় উপমহাদেশেও অনেক কবি-সাহিত্যিক, পীর মাশায়েখ রয়েছেন। তবে রুবাইয়াত-এর মাধ্যমে সুফিদর্শনকে প্রথম দিকে যারা প্রচার করেন তাদেও মধ্যে ফার্সি কবি ওমর খৈয়াম। রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম বা ওমর খৈয়ামগীতি সৌন্দর্য বোধসম্পন্ন সত্যের আবিষ্কার।
ওমর খৈয়াম এর রুবাইয়াত সার্থক ও সুন্দরতম অনুবাদ করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। মূলত এই অনুবাদের মাধ্যমে বাংলাভাষায় রুবাইয়াত প্রকাশ করেছেন কাজী নজরুল। এরপর সৈয়দ মুজতবা আলীসহ অনেকেই অনুবাদ করেছেন। পরবর্তীকালে অনেকেই বাংলা ভাষায় রুবাইয়াত লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যে সর্বাধিক মৌলিক রুবাইয়াতের লেখক অধ্যাপক ড. গাজী আব্দুল্লাহেল বাকী ও তিনিই বাংলাদেশে সম্ভবত প্রথম রুবাইকার। তিনি কিছু বৈশিষ্ট্য এবং মাধুর্যেও দিক থেকে কবি ওমর খৈয়ামের অনুসরন করেছেন তবে অনুকরণ করেননি। তিনি স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় অন্তর উৎসারিত চেতনা বোধ দিয়ে শীলিত শব্দ-চয়নে, ছন্দ-বাক্যালংকারে বিভূষিত করে রুবাইয়াত রচনা করে বাংলা সাহিত্যের নবদিগন্ত উন্মোচিত করেছেন।
এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে রুবাইয়াত-ই বাকী ছন্দ বাক্যালংকার কতোটুকু সফল তা দেখা যাক, তবে তা অনুপুঙ্খরূপে আলোকপাত করার প্রত্যাশা অরণ্যে রোদনমাত্র। রুবাইয়াত-ই বাকীর অন্যতম বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ উপমায়, উৎপ্রেক্ষায়, উচ্ছল ছন্দে ও বিকল্পহীন চিত্রকল্পে। এবং মানবমনের নিগুঢ় নিস্বার্থ প্রেমজ প্রত্যাশাকে ভাবব্যাঞ্জনার মাধ্যমে স্রষ্টার সাথে সুনিবিড় সম্পর্কের এক ঐশ্বরিক সুতায় অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করা। স্রষ্টার সাথে মানব সম্পর্কের এক নতুন দিক উন্মেচিত করা। যেমন তিনি লিখেছেন-
খোদার প্রণয় দিয়ে মাজা স্বর্গ-সুখের আরাম আলয়,
নূরের শিশির ঝরবে যেথায় প্রেমিকগণের ঘিরে নিলয়।
শরাব কণ্ঠক-হুর গেলমান স্বচ্ছ যাদের দেহের আকার,
উৎস সৃজন মূল প্রেমেতে হয় না যাহার আদৌ বিলয়।
পরম আত্মার সাথে মানবাত্মার সংযোগ স্থাপন সুফি দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গা; যে বিষয়টি সুন্দর করে, সুচেতনা দিয়ে, সুশব্দ প্রয়োগে, সৌন্দর্য বিকিরিত বাক্যের প্রতিলিপি দিয়ে সাজানো যেন রুবাইয়াত-ই বাকী।
ছন্দ ও বাক্যালংকার:
বর্ণিত লেখকের রুবাইয়াত স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত। এ ক্ষেত্রে মিল তথা অন্তমিল হয়তো সর্বত্র সুরক্ষিত করা সম্ভব হয়নি তবে তা রুবাইয়াতের ক্ষেত্রে বিচার করা কঠিন, কারণ খৈয়ামের অনেক রুবাই-এ চার চরণে একই মিল। অনেক সময় বাকীর রুবইয়াতে শেষ পর্বে ৩/২ মাত্রাও লক্ষ্য করা যায়। তবে ছন্দে এমন সামান্য কিছু বৈসদৃশ্য ব্যতীত সর্বাঙ্গীন সুন্দর। শব্দ বন্ধন সৃষ্টিতে নতুনত্ব রয়েছে। এরূপ একটি রুবাই এর উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে:
’ধৈর্য কভু নেইকো ধরায় সহনশীলের অমর জ্যোতি,
হারিয়ে হেছে ভালোবাসার সুহৃদজনের মিলন দ্যূতি।
হাজার খন্ডে চলছে ধরা নেই সমতার চিহ্নরেখা,
বিবেক হতে ঝরছে লহু সহিষ্ণুতার নেইকো স্মৃতি।’
যদি পংক্তির শেষে ’তি’ দিয়ে অন্ত্যমিল করা হয় তাহলে সঠিক আছে। কিন্তু ছন্দালংকারে হয়তো কেহ কেহ এটিকে সঠিক বলতে চান না। ছন্দ ব্যকরণ অনুযায়ী ’জ্যোতি’ ’দ্যূতি’ ও ’স্মৃতি’র মিল বিন্যাস দেখতে হবে। অনেকের মতে সে হিসেবে এসব অন্তমিল পুরোপুরি সঠিক নয়, কিন্তু বিখ্যাত কবিদের কবিতায় এ ধরনের অন্তমিলের ব্যবহার প্রভূত লক্ষ্য করা যায়, নীীচে বেশ কিছু উদ্ধৃতি প্রদান করা হলো। বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের অনেক সুললিত রাধাকৃষ্ণের প্রণয় লীলা সম্পর্কিত কবিতাবলীতে এ ধরনের ছন্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন গোবিন্দ দাসের ’শ্রীগৌরঙ্গ’ নামক কবিতায়:
গৌরঙ্গের নিছনি লইয়া মরি।
ও রূপ-মাধুরি পীরিতি-চাতুরি
তিল-আধ পাশরিতে নারি।। (বিদ্যাপতি-চন্ডিদাস পৃ: ১১)
মহাকবি আলাওলের কবিতায় এ ধরনের ছন্দের ব্যবহার লক্ষ্যনীয় যথা:
সবভাসি গেল জলে।
দারুণি পদ্মের নালে।।
অথবা: পরে নাহিকো সীমা।
জগৎ-মোহিনী বামা।। (বিদ্যাপতি-চন্ডিদাস পৃ: ১১৫)
অথবা: সৈয়দ মর্ত্তুজার গানে:
শ্যম বঁধু, আমার পরাণ তুমি।
কোন শুভ দিনে দেখা তোমার সনে
পাশরিতে নারি আমি।। (বিদ্যাপতি-চন্ডিদাস পৃ: ১৪৩)
অথবা: চন্ডিদাসের কবিতায়:
আমার বাহির দূয়ারে কপাট লেগেছে
ভিতর দুয়ার খোলা।
তোরা নিসাড় হইয়া আয় লো সজনি
আঁধার পেরিয়ে আলা।। (বিদ্যাপতি-চন্ডিদাস পৃ: ২৮১)
অথবা: বিদ্যাপতির কবিতায়:
তরইতে ইহ ভবসিন্ধু
তিল এক দেহ দীনবন্ধু।। (বিদ্যাপতি-চন্ডিদাস পৃ: ২৭৭)
অথবা: দ্বিজ চন্ডিদাসের কবিতায় যথা:
চন্ডিদাস মনে মনে হাসে।
এরূপ হইবে কোন দেশে।। (বিদ্যাপতি-চন্ডিদাস পৃ: ২)
পরবর্তিতে ’বউ কথা কও’ কবিতায় মহাকবি কায়কোবাদ এর ধ্বনি এভাবে উচ্চারিত:
এমনি মধুর স্বরে সে গাইত স্বজনি
—————
মধুর চাঁদনিময়ী মধুমাখা যামিনী (বাংলা কবিতা: পৃ: ৫৪)
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ’শা-জাহান’ কবিতার মধ্যে এ ধরনের ছন্দমিল লক্ষ্য করা যায়:
রূপহীন মরণেরে মৃত্যুহীন অপরূপ সাজে!
রহে না যে
অথবা:
প্রেমের করুণ কোমলতা,
ফুটিল তা
তদরুপ: দ্বিজেনদ্রলাল রায় এর কবিতায়: ছন্দ প্রকরণ যথা ’মিশে’–’দেশে’! সত্যেনদ্রনাথ দত্তের ’কিশোরী’ কবিতায়: ’বুকে’–’দেখে’; জাতীয় কবি নজরুলের ’প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় ’জলে’–’দোলে’, ’সিন্ধু’ কবিতায় ’নভে’–র’বে’, ’জানাশোনা’–’আাপনা’ অথবা ’নির্মম’–’সম’ ইত্যাদি।
তবে এ ধরনের কিছু সংখ্যক রুবাই ব্যতিত শেষ পর্বে মাত্রা বিন্যাস তারতম্যের কারণে বরং ছন্দগত শ্বাসাঘাত উৎকৃষ্ট হয়েছে এবং নান্দনিক কাব্য সৃষ্টি হয়েছে।
৪ ৪ ৪ ৩
’রিক্ত হলে/ কিরণ হতে/চন্দ্র-সাকীর/রূপ-বাহার, ৪+৪+৪+৩
আর থাকে না/তিল পরিমান/অপরূপ সে/মূল-আকার। ৪+৪+৪+৩
প্রেমের কিরণ/উধাও হলে/ভেঙে পড়ে/হৃদ-মহল, ৪+৪+৪+৩
জীবন নদী/যায় শুকিয়ে/কিরণ-বিহীন/চাঁদ-সাকার ৪+৪+৪+৩
এছাড়াও তাঁর রুবাইয়াত বিশ্লেষণ করলে বহুপ্রকার অর্থালংকার পরিদৃষ্ট হয়। উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, অতিশয়োক্তি, প্রতিবস্তুপমা, ভ্রান্তিমান, সমাসোক্তি, প্রতীপ, সন্দেহ, দৃষ্টান্ত, তুল্যযোগিতা, অর্থাপত্তি, অনন্বয়, সূক্ষ্ম অলংকার এবং অর্থশ্লেষও রুবাইয়াত-ই বাকীতে বিদ্যমান। এ সমস্ত অর্থালংকার বর্ণিত লেখকের রুবাইয়াতকে অতিশয় মাধুর্যমন্ডিত ও অর্থপূর্ণ করে তুলেছে।
রুবাইয়াত-ই বাকীর নান্দনিকতা স্বতঃস্ফূর্ত। তার রচিত কয়েকটি রুবাইয়াত বিশ্লেষণ করলেই সামগ্রিক ধারণা পাওয়া অত্যুক্তি নয়। শব্দের সৌকর্যে সাহিত্য হয় হৃদয় ছোঁয়া। নূপুরের নিক্কন কিংবা জলতরঙ্গ হিল্লোল যেমন শ্রুতিমাধুর্য সৃষ্টি করে তেমনি শব্দের সুনিপুন ব্যবহার ও একই শব্দে একই ধ্বনির পুনঃপুনঃ ব্যবহার বাক্য হয়ে ওঠে কাব্যময়। রুবাইয়াত-ই বাকীতে এমন উদাহরণ অজস্র ও অবিরল। শব্দালংকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় অনুপ্রাস। একই ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ বাক্যে বার বার ব্যবহৃত হয়ে ছন্দে ঝংকার তুললে তাকে অনুপ্রাস বলে।
৩৮৪
’ভন্ডেরা সব মুক্ত মঞ্চে অধিকারের ধ্বনি তোলে,
তাদের মাঝে এক আসনে বক্তা আমি উচ্চরোলে।
হরণ করা হক অধিকার একদিনে সব দেই ফিরিয়ে।
এমন সত্যের অপলাপে আঁখির কোণে অশ্রু দোলে।’
উল্লেখিত রুবাইয়াতের প্রথম পংক্তিতে ’ম’ ’র’ ’ধ’ ধ্বনির অনুপ্রাস সৃষ্টি হয়েছে। তৃতীয় পংক্তিতে ’হ’ ’ক’ ’র’ ’দ’ এর অনুপ্রাস পরিলক্ষিত। এছাড়াও তৃতীয় পংক্তিতে ’হরণ করা হক অধিকার’ এর মাঝে হরণ-হক, করা ও অধিকারের ’কার’ এর সাথে এক ধরনের অনুপ্রাস সৃষ্টি হয়েছে।
অন্ত্যানুপ্রাস:
অন্তমিলসম্পন্ন সকল কবিতায় এই অনুপ্রাস সহজেই দৃশ্যমান। যেমন ৩৮৪ নম্বর রুবাইয়ের পংক্তিগুলোর শেষ শব্দ ’তোলে’ ’রোলে’ ’দোলে’। এখানে ’ল’ ধ্বনির অন্ত্যানুপ্রাস সৃষ্টি হয়েছে।
বৃত্ত্যনুপ্রাস/গুচ্ছ অনুপ্রাস:
একটি ব্যঞ্জনধ্বনি একাধিকবার ধ্বনিত হলে অথবা ব্যঞ্জনধ্বনি গুচ্ছাকারে ক্রমানুসারে সংযুক্ত অথবা অযুক্ত বা বিযুক্তভাবে বারবার ধ্বনিত হলে গুচ্ছ অনুপ্রাস/ বৃত্ত্যনুপ্রাসের সৃষ্টি হয়। রুবাইয়াত-ই গাজী আব্দুল্লাহেল বাকী বইয়ের ৭৬৬ নম্বর রুবাইতে লেখক লিখেছেন।
’মাফ করে দাও মহান খোদা অধম বাকীর এই আরজ,
কবুল করে নাওগো সেজদা দাওগো করে দিল সহজ।
তোমার পথে চালাও খোদা আমি পাপী দীন ফকির,
পারিনাকো করতে পালন তোমার আদেশ সব ফরজ।’
বর্ণিত রুবাই এর দ্বিতীয় পংক্তিতে লেখক সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন ’কবুল করে ’নাওগো’ সেজদা ’দাওগো’ করে দিল সহজ।’ এখানে ’নাওগো’ ’দাওগো’ এর মাঝে বৃত্ত্যনুপ্রাস সৃষ্টি হয়েছে।
রুবাইয়াত-ই বাকীর দার্শনিক সত্য সুফিবাদ। এক আল্লাহর নৈকট্য অর্জনই মূল প্রতিপাদ্য। ¯্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে বিদ্যমান অদৃশ্য পর্দাকে উন্মোচিত করে স্রষ্টার সাথে একীভূত হওয়ার এক অমোঘ অভিপ্রায়ে রচিত পংক্তিগুলি সত্যিই অসাধারণ, সার্থক ও সফল। তাঁর রুবাইয়াতের নানা দিক নিয়ে গবেষণা বাংলাসাহিত্যে প্রাণ সঞ্চার করবে বলে আশা করা যায়।
লেখক: বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার ও কলামিস্ট
খুলনা গেজেট / এমএম