খুলনা, বাংলাদেশ | ৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৪ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  সাবেক প্রধান বিচারপতির মৃত্যুতে আজ সুপ্রিম কোর্টের বিচারকাজ বন্ধ
  সিইসিসহ নতুন নির্বাচন কমিশনারদের শপথ আজ
  অ্যান্টিগা টেস্ট: ৪৫০ রানে ইনিংস ঘোষণা ওয়েস্ট ইন্ডিজের, দ্বিতীয় দিন শেষে বাংলাদেশ ৪০/২

রাহুগ্রাস (পর্ব ০৮)

গৌরাঙ্গ নন্দী

শিবুর বয়স তখন আর কত হবে? এই সাত বা আট। তখন দেশে যুদ্ধ হয়। স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ। মুক্তির জন্য যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ। পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানকে খুবলে খুবলে খাচ্ছিল। তাই যুদ্ধ! তবে যুদ্ধ বাঙালিরা আগে বাঁধায়নি। সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ ভোটে জিতলো। কিন্তু তাঁরে ক্ষমতা দিলো না। উল্টো ২৫শে মার্চের রাতে ঢাকায় পাকিস্তানী সেনারা কামান নিয়ে নামলো। বিশ^বিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, আশেপাশের এলাকায় নির্বিচারে গুলি ও গান-পাউডার ছড়িয়ে আগুন ধরিয়ে দিলো। এক রাতেই কতোজন যে মারা পড়লো, তার লেখাজোখা নেই। মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে আসতে শুরু করলো। পাশাপাশি পাকিস্তানী মিলিটারিরাও আসতে শুরু করলো।

গ্রামেও যুদ্ধের দাপট শুরু হয়েছে। মুসলিম লীগসহ আরও কতিপয় দলের নেতা-কর্মীরা পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার শপথ নিয়েছে। রেডিও পাকিস্তান-এর খুলনা শাখা হতে ভাষণ দিয়েছে মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর। তিনি পাকিস্তানের অখÐতা বজায় রাখার জন্যে সকলের প্রতি আহŸান জানিয়েছেন। পাকিস্তান হয়েছিল মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যায় বেশী বলে। পাকিস্তানের ছিল দুটো অংশ। একটি পশ্চিমে; অন্যটি পূবে। পূবের অংশটি বাংলার পূর্ব ভাগও। এই পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা বেশী ছিল; তাই এই অংশটুকু পাকিস্তানের অংশ হয়। মুসলিম প্রধান পূর্ব পাকিস্তানেও স্বাভাবিকভাবে পাকিস্তান রক্ষার দাবিদারদের চোখে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সাধারণভাবে হিন্দু বলা হয়। পাকিস্তান রক্ষার দাবিদাররা প্রচার শুরু করে, ভারতের চক্রান্তে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান ভাঙ্গতে চায়। হিন্দুরা হলো তাদের সহযোগী। ফলে হিন্দুদের হঠিয়ে দিতে হবে। যুদ্ধের শুরু থেকেই তাই হিন্দুদের উপর আক্রমণ হতে থাকে।

মার্চ মাসের শেষের দিক হতে পুরো এপ্রিল এবং মে মাস জুড়ে চলে হিন্দুদের উপর ব্যাপক অত্যাচার-নির্যাতন। লুট-পাট, হামলা, নারীদের উপর আক্রমণ কি-ই-না! হিন্দু জনগোষ্ঠী তাদের ভিটে-মাটি ছেড়ে চলে যেতে শুরু করে। দাকোপ এলাকার মানুষ শুরুতে যেতে চায়নি। কিন্তু লুটপাটের জন্য আক্রমণ বাড়তে থাকায় এক সময় এলাকাবাসী ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রকৃতপক্ষে, লুটপাটের কারণে হামলা আর পাকিস্তানী সেনাদের সুন্দরবনে যাওয়া-আসায় মানুষের মনে আতঙ্ক বাঁধতে শুরু করে। এরই মাঝে আশে-পাশে সব ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটতে থাকে।

বাজুয়া বাজার স্কুল ও স্কুলমাঠে তখন শরনার্থীদের ভীড়। বিকেলের দিকে পাকিস্তানী সেনারা বাজুয়া বাজারে আক্রমণ চালায়। তারা গুলি করতে করতেই বাজারে নামে। এতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যেসব মানুষ ছুটে পালাতে গিয়েছে, তারাই পাখির মতো মারা পড়েছে। সেখানে তখন বাগেরহাট জেলার রামপাল এলাকার পিপুলবুনিয়া, জয়নগর, ভাগা, ভেকটমারী, নাদেরহুলা প্রভৃতি গ্রামের লোক ছিল। পাকিস্তানী সেনাদের হাতে জীবিত অবস্থায় ধরা পড়েন পিপুলবুনিয়া গ্রামের হরিপদ মুখার্জী। তাকে পাকিস্তানী সেনারা নানা কথা জিজ্ঞাসা করে তাঁর সারা শরীর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। অন্য মৃতদের নিথর দেহগুলো পাশের পশুর নদীতে ফেলে দেয়।

একইভাবে চালনা বাজারে পলায়নপর শরণার্থীদের উপর হামলা চালানো হয়। সেখানে বেছে বেছে দশজন পুরুষ সদস্যকে হত্যা করে আক্রমণকারীরা। ফকিরহাটের দে-পাড়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন পাকিস্তানী হানাদার ও রাজাকারদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে এই বাজারে উঠেছিল। তাঁরাই আক্রমণের শিকার হয়। চালনা ইউনিয়নে ঝপঝপিয়া নদীর তীরে পানখালি গ্রামেও স্বাধীনতা বিরোধীরা সংগঠিত হয়। তারা সাহেবেরাবাদ গ্রামে হামলা করে। সেখানেও বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩/৪শ’ নৌকা বোঝাই হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা নদী-পথে ভারতে যাওয়ার সময় সাহেবেরাবাদ ঘাটে এসে যাত্রাবিরতি করছিল। এ সময় পাকিস্তানী সেনারা সাহেবেরাবাদের স্কুল-মাঠে ব্রাশফায়ার করে অসংখ্য শিশুসহ প্রায় তিন হাজার নারী-পুরুষকে হত্যা করে।

এসব এলাকার তাড়া খাওয়া শরণার্থী দলটির বিশাল বহর নৌকা যোগে সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে ভারতের দিকে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে শিবসা নদীর পাড়ে, হড্ডা গ্রামের এক জায়গায় খাবারের জন্যে তাঁরা জড়ো হন। সেখানে শরনার্থীদের উপর আবু সাত্তার নামের এক লুটেরা বাহিনী হামলে পড়ে। সাত্তার বাহিনীর গুলিবর্ষণে সেখানে বিশের অধিক সদস্য মারা যান। এই শরণার্থী দলের কাছে একটি বন্দুক ছিল, তারা তাই দিয়ে আক্রমণকারীদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। এতে আক্রমণকারীদের হোতা আবু সাত্তার সেখানে মারা যায়। শরণার্থী দলটির স্বেচ্ছাসেবক ক্ষিতীশ ঢালীও সেখানে মারা যান।

এসব দেখে-শুনে ঢাকি নদীপাড়ের বাসিন্দারাও গ্রাম ছেড়ে ভারতের উদ্দেশ্যে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। একদিন সকালে নৌকাযোগে পাশের আরও দুটো পরিবারের সদস্যদের সাথে শিবুদের পরিবারের সকলেই ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। শিবু তার মায়ের আঁচল ধরে আছে। মায়ের একেবারে কাছ ছাড়া হতে চায় না সে। প্রায় সারাদিন নৌকায় তারা। কখনও সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে, কখনও নদী দিয়ে তারা এগিয়ে চলে। শিবুর খিদে পেলে জামার কোচড়ে কিছু মুড়ি আর পাটালি গুড় দেয় তার মা। শিবু তাই খেয়েছে। সবার চোখেমুখে একটা ভীতির ভাব। মা তাকে বলেছে, ‘বাবা, খান সেনারা মানুষ মাইরে ফেলতিছে। আমাইগে তাড়াতাড়ি চইলে যাতি হবে। তাড়াতাড়ি ভারতের মধ্যি পড়তি পারলি আমরা বাঁচবো। তা না হলি খানেদের সামনে পইড়ে গিলি আমাইগে গুলি কইরে মাইরে ফেলবে। তুমি একটু শান্ত থাকো।’

এসব কথায় শিবু’র গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। সে চুপচাপ নদীতীরের গাছপালা দেখতে শুরু করে। নদীতে একটি শুশক হাতির শুড়ের মত মাথার সামনের অংশটুকু তুলে মোটা শরীরটাকে গোলাকার বৃত্তের মতো ঘুরিয়ে ডুব দেয়। শিবু পরে জেনেছে, শুশক আসলে এক ধরণের ডলফিন। এটিকে গাঙ্গেয় ডলফিন বলা হয়। জেলেদের জালে আটকে পড়ে মারা যেতে থাকে। এখন তারা একটি বড় নদীতে পড়েছে। পাড়ের কিছুই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। আরও অনেক নৌকা। কোথা হতে এতো নৌকা এলো। মা-কে সে জিজ্ঞেস করতে চায়। কিন্তু মা যদি আবার ধমক দেয়। তাই সে চুপ করে থাকে। সকল নৌকাই একদিকে এগিয়ে চলেছে। বড় নদী থেকে নৌকাটি আবারও একটি ছোট নদীতে পড়ে। কিছুদূর যাওয়ার পর আবারও বড় নদী। নৌকাগুলোর গতি আচমকাই যেন বেড়ে গেছে।

নৌকাগুলো কি পাল্লা দিচ্ছে। নৌকার গতি দেখে শিবু কেমন যেন ঘাবড়ে যায়। এত্তো জোরে নৌকা চলতে পারে! পাশাপাশি নৌকা চলতে গিয়ে তাদের নৌকার সাথে অন্য আর একটি নৌকার টক্কর লাগে। তাতে নৌকায় দুলুনি তৈরি হয়। শিবু একদিকে কাত হয়ে পড়ে। মা তাকে ধরে ফেলে। তাদের নৌকাটি নদী পাড়ি দিতে শুরু করেছে। আগে অনেক চলে গিয়েছে। পিছন দিকে আরও অনেক নৌকা। নৌকার সারি। আর দাড় ও বৈঠা বাওয়ার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শোণা যাচ্ছে। কে যেন বলে ওঠে, ‘খানেদের গানবোট আসতিছে, তাড়াতাড়ি বাইয়ে চলো। নদীর অর্ধেক পার হতি পারলি আমাইগে আর ধরতি পারবে না। ওই দেখ, ভারতীয় সেনাদের গানবোট টহল দিচ্ছে।’

মুহূর্তখানেক যেতে না যেতেই গানবোটের আওয়াজ স্পষ্ট হয়, শুরু হয় গুলি। ফট, ফট, ফট আওয়াজ। ক্রমাগত শব্দ, আগুনের ফুলকি। চারিদিকে আর্তনাদ। ততক্ষণে শিবুদের নৌকা নদীর মাঝ বরারবর পার হয়ে ভারতীয় সীমানায় চলে গিয়েছে। আর পাকিস্তানের সীমানার মধ্যে পড়ে থাকা নৌকাগুলো হতে ক্রমাগত আর্তনাদ ও কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে। শিবু ভয়ে জড়োশরো হয়ে পড়ে। মা তাকে কোলের মধ্যে নিয়ে অভয় দিয়ে বলে, ‘আমাইগে আর ভয় নেই। আমরা ইন্ডিয়ার মধ্যি চইলে আইছি। আমাইগে আর খান সেনারা কিছু বলতি পারবে না।’

শিবু মুখ তুলে বলে, ‘মা, ওই যে নৌকাগুলো।’ মা জবাব দেয়, ‘জানিনা, বাছা; ওই নৌকোর মানুষগুলোর কি অবস্থা। খানেদের মুখি পড়া মানেতো যমের মুখি পড়া। ওরা কি আর কাউরে বাঁচায় রাখতিছে। আমরা শেখ মুজিবির নৌকোয় ভোট দিলাম বইলে আমরা পাকিস্তানের শত্রæ হলাম। আমাইগে উপর যতো আক্রমণ। লুট-তরাজ, মাইরে ফেলানো; ভিটে ছাড়া করা। আর কি আমরা আমাইগে দেশে ফিরতি পারবো!’

যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে শিবুরা আবারও দেশে আসে। বাঁধের ভিতরে তখোন মিষ্টি পানি। বছরে একবার ধান হয়। আমন ধান। তাতেই খাওয়া-দাওয়া, বাকি খরচ। আর আছে নানান মাছের বাহার। এরই মাঝে শুরু হলো ওই বাঁধ কেটে নোনা পানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ। বেছে বেছে গরীব মানুষের বসতিতেই যেন সকল ধরনের উৎপাত। গরীব মানুষগুলোর জমি-জমা-বসতভিটের উপর যতো আক্রমণ। বটিয়াঘাটার করেরঢোনে শহুরেরা বাগদা চিংড়ির চাষ করতে গিয়েছিল। জমির মালিক, বর্গাদাররা মিলে সেখানে বাধা দিয়েছে। দুই পক্ষের লড়াই হয়, তাতে জাবের শেখ মারা যায়। সেখানে আর চিংড়ি চাষ হয়নি। কিন্তু ডুমুরিয়া-কেশবপুর সীমান্তে ডহুরির বিলে গোবিন্দ মাস্টার চিংড়ি চাষীর গুলিতে প্রাণ দিয়েও চিংড়ি চাষ থামাতে পারেনি। আসলে দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার সব জায়গায় সব সময় হয়। গরীবতো সেই দুর্বলের অংশ। আর রাষ্ট্র-সরকার সবল মানুষের পক্ষেই কাজ করে।

শিবু’র বাবার কথা মনে পড়ে। বাবা বলতো, আমরা আর কৃষক নেই, আমরা সবাই জাইলে হয়ে গেছি। হ্যাঁ, এখন চিংড়ি পোনা ধরে, ঘেরে ছাড়ে। আগে চিংড়ি পোনা বিক্রি করতো, এখন নিজেরাই চিংড়ি ঘের করে। তাতেই পোনার প্রয়োজন হয়। বছর দশেকের মাথায় বাইরের চিংড়ি চাষীরা চলে যায়। এখন এলাকার মানুষেরা নিজেরাই চিংড়ি ঘের করে। না করে উপায় কি! নোনায় সব তিতো হয়ে গেছে। এখন ধানের ক্ষেতে নোনা, মাটিতে নোনা, খালের পানিতে নোনা, পুকুরগুলোর পানিও নোনা। খালগুলো সব রাষ্ট্রের পক্ষ হতে চিংড়ি-চাষীদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। চিংড়ি চাষীরা সেখানেও চিংড়ি চাষ করতো। বাইরের চিংড়ি চাষীরা চলে যাওয়ার পর এলাকার প্রভাবশালীরা সেই খালগুলো বরাদ্দ নিয়েছে।

শুধুমাত্র রং বদল হয়েছে। আগে ছিল শহুরে ধনী, শহুরে মাস্তান। এখন হয়েছে এলাকার ধনী, এলাকার মাস্তানদের দাপট। শিবুর মায়ের শরীর খারাপ। কয়েকদিন থেকেই সে বলতে শুরু করেছে, শিবু, আমি তোর বাবার কাছে চলে যাবো। সময় হয়েছে-রে, তোর বিয়েটা দিয়ে যেতে পারলে আমার শান্তি। কিন্তু আমি কি সেই সময় পাবো। তিনি নানান জনকে বলতেও শুরু করেছেন, শিবুর জন্যি মেয়ে দেখো। শিবুরে বিয়ে দেবো। বড় দুই দাদা, বৌদি, আত্মীয়-স্বজন কাউকেই বলতে বাদ দেয়নি। এখন যাকে পায়, যার সাথে দেখা হয়, তার সাথেই ওই এক কথা, শিবুর বিয়ে; মেয়ে দেখা। কখনও কখনও খুবই মেজাজ দেখায়, নিজের উপর। ‘আমি সুস্থ থাকলে আমিই মেয়ে খুঁজে শিবুর বিয়ে দিতাম।’

একসময় দেখাশোনা হলো। পাইকগাছার সোলাদানা গ্রামের কার্তিক মÐলের মেয়ে অনিতার সাথে শিবুর বিয়ে ঠিক হয়। সেও মেয়ে দেখতে গিয়েছিল। মেয়ে দেখতে গিয়ে নিজেই সে যেন লজ্জায় কুঁকড়ে মরে যায়। মেয়ে দেখার নানান ধরনের কথা শুনে সে মনে মনে খুব বিরক্ত। কেউ কেউ না-কি মেয়ের হাত, পা, গায়ের রং, চুলের গোছা কেমন, তাও দেখে। এসব শিবুর একেবারে অপছন্দ। সে যখন মেয়ে দেখতে গিয়েছিল, এসব একদম করেনি। সে যেতেও চায়নি। তবুও তাকে যেতে হয়েছিল। অনিতার মুখোমুখি সে তাকাতে পারেনি। একটু আড়চোখে দেখে নিয়েছিল। তাতেই অনিতাকে তার পছন্দ হয়।

একদিন দল বেঁধে নৌকায় চেপে শিবসা নদীপাড়ের সোলাদানা গ্রামের অনিতাকে বৌ করে এনে ঘরে তোলে। বিয়েতো নয়, একটি ধর্মীয় আচার। এখনও অগ্নিকে সাক্ষীকে করে বিয়ে। দুটি নর-নারীর মধ্যে আত্মিক বন্ধনের এটাই উপায়! হায়! এই বন্ধন না-কি ছিঁড়ে যাওয়ার নয়। কিন্তু শিবু-অনিতার জীবনটা কেন যেন স্বাভাবিক হয়নি। পরষ্পরের প্রতি ভালোবাসা-শ্রদ্ধাবোধ-সহমর্মিতার কোথাও যেন একটি ঘাটতি ছিল। অনিতা সংসারের প্রয়োজনে কাজ করতো। বাড়ির অন্যদের সাথে ভালো ব্যবহারও করতো, কিন্তু শিবুকে দেখলেই কেন যেন সে বিরক্ত হতো। শিবু-ই যেন তার রাজ্যির বিরক্তি। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মা মারা গেছেন। তার এক বছরের মাঝে তাঁদের ঘরে এসেছে হাসি। ফুটফুটে এক কন্যাশিশু। সকলেই বলাবলি শুরু করেছে আবারও শিবুর মা, মেয়ে হয়ে শিবুর কোলে ফিরে এসেছে।

এসব শিবু বোঝে না। বুঝতে চায়ও না। এ জন্ম, পরের জন্ম, এসব কি! ঠাকুর-দেবতায় এতো ভক্তি করে কি-ই-বা হয়। মানুষ মানুষের উপরতো ঠিকই শক্তি খাটায়। ক্ষমতাধর ব্যক্তি ঠিকই গরীবের উপর অত্যাচার করে, বল খাটায়। গরীবেরা কষ্টে, আরও কষ্টে পড়ে। দেবতাতো গরীবকে রক্ষা করতে আসে না। দেবতা কি সবসময় ধনীদের পক্ষের লোক। গরীব মানুষগুলোর প্রতিদিনের খাবার জোগাড়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। কাজ, আর কাজ। কাজ খোঁজ। কাজ না পেলে উপোষ করে থাকা। নিজে কি করছো, কিভাবে অর্থ জোগাড় করা হচ্ছে, কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করা হচ্ছে; এটাই প্রধান। প্রতিবেশী না খেয়ে থাকলেতো প্রতিবেশী তার উপর সদয় হয় না। আবার, ধনীরাতো গরীবদের উপর অত্যাচার-অনাচার করেই চলেছে। গরীবদের দুর্দশাতো কোন কালেই কাটে না। দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান গরীবদের প্রতি সদয় নয়। রাষ্ট্র ও সরকারের দরদ ধনীদের উপর; কোন নীতি-আইন গরীব মানুষদের রক্ষা করে না। যে সব ধনীদের টাকা আছে, রাষ্ট্র-সরকার তাদেরকে সমর্থন করে। এ কারণে শহুরে ধনীরা যখন সুন্দরবন-ক‚লের এই শান্ত গ্রামটিতে চিংড়ি চাষ করতে আসে, তখন রাষ্ট্র-সরকার তাদের সহায়তা করেছিল। এই চিংড়ি চাষের কারণে গরীব কৃষিজীবীর কাজ চলে যায়, এলাকায় অত্যাচার-নির্যাতন বাড়ে, হত্যা-আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে; কোই, তখনতো এই গরীব মানুষের পক্ষে রাষ্ট্র বা সরকার কোন ব্যবস্থা নেয়নি। শহুরে ধনীরা বছরের পর বছর চিংড়ি আয়ের টাকা নিয়ে আবার শহরে ফিরে গেছে। তারা সেই টাকায় শহরে ব্যবসা করছে। আর এখন, গ্রামের এসব জমিতে চিংড়ি চাষ ছাড়া কিছুই হয় না; এলাকাবাসী তাই চিংড়ি চাষ করছে; কিন্তু আগের মতো চিংড়িতে লাভ নেই। জমির মালিকরা যাহোক দুটো টাকা আয় করতে পারছে; কিন্তু গরীব মানুষগুলোর ওই মরণদশা! জগতে কি গরীব মানুষগুলোই অপয়া!

শিবু’র আয় কম। আগের সেই একান্নবর্তী পরিবার আর নেই। এখন তিন ভাইয়ের পৃথক তিনটি সংসার। একই বাড়িতে তিন দিকের তিনটি ঘরে তিন ভাইয়ের বসবাস। রান্নাঘর একটি। সেখানেই তিন পরিবার মিলেমিশে রান্না করে; অথবা কখনও কখনও নিজেদের ঘরের বারান্দার এক কোণেও রান্না করে। অন্য দুই ভাইয়ের আয় বেশ ভালো। শিবু আর্থিক দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে। এটাও একটি যন্ত্রণা। বৌ অনিতার এটি ভালো লাগে না। তার অনেক কিছু দরকার। সেই প্রয়োজন মেটাতে পারে না শিবু। অনিতা তাই খিটিমিটি করে। কথায় কথায় শিবুকে গালমন্দ করে।

শিবু তার সাধ্যমতো চেষ্টা করে। সে দিনমজুরি করে। নদীতে চিংড়ি পোনা ধরে; কখনও কখনও চিংড়ি পোনা ধরতে সে সুন্দরবনেও যায়। আজকাল আর আগের মতো চিংড়ির পোনা পাওয়া যায় না। তবে এখনও প্রাকৃতিক উৎসের চিংড়ি পোনার চাহিদা আছে। কৃত্রিম উপায়ে তৈরি চিংিড়র পোনায় সহজে ভাইরাস আক্রমণ করে। এতে চিংড়ি চাষীর ক্ষতি হয়; তাই প্রাকৃতিক উৎসের চিংড়ির প্রতি টান বেশী। আগে ঢাকি নদীতেই প্রচুর চিংড়ি পাওয়া যেতো; এখন কমেছে। কমবেই বা না কেন? একটি চিংড়ি পোনা ধরার জন্যে শত শত অন্য মাছ ও চিংড়ির পোনা মারা যায়। ফলে চিংড়ির পাশাপাশি অন্য মাছও কমেছে। আগে খালে-বিলে অনেক মাছ পাওয়া যেতো। সকাল বেলায় খেওলা জালের এক টানে যে মাছ উঠতো, তা আর নেই। মাছগুলো সব যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। এখন চারিদিকে যা আছে, তা চিংড়ি। সুন্দরবনের খুবই বিখ্যাত মাছ ভেটকিও এখন ঘেরে চাষ হয়; পাশাপাশি পারসে আর টেংরাও ওই ঘেরেই আশ্রয় নিয়েছে। সবুজ রেখা টানা টেংরা আর মেলে না; এখন পাওয়া যায় নোনা টেংরা, পেট মোটা, একটু বড় সাইজের।

নদী-খালে চিংড়ি পোনাও আর পাওয়া যায় না। চিংড়ি পোানার পাশাপাশি এখন আর একটি পণ্যের চাহিদা বেড়েছে, তা হচ্ছে কাঁকড়া। শিবুসহ এই এলাকার চিংড়ি পোনা ধরা মানুষগুলো এখন ছোট কাঁকড়া ধরে, এর চাহিদা বেশী, দামও ভালো মেলে। এই কাঁকড়া খামারে ছোট ছোট বাক্সের মধ্যে দুই-তিন মাস আটকে রেখে খাবার খাওয়ানো হয়। এতে কাঁকড়াটি মোটাতাজা হয়। তখন ব্যবসায়ীরা বেশ মোটা দামে কিনে নেয়। এটাও এখন রফতানি হয়। নোনা জলের বাগদা চিংড়ি যেমন ১৯৮০-র দশকে রপ্তানি পণ্য হিসেবে তরতর করে বাড়তে থাকে; এখন কাঁকড়ার চাহিদাও তেমনি বাড়ছে। কাঁকড়ার খামার হচ্ছে। সুন্দরবন হতেই এই ছোট কাঁকড়া বেশী সংগ্রহ করা হয়। শিবু’র ভাবনায় কেমন যেন ছেদ পড়ে; আচ্ছা, চিংড়ি পোনা বেশী ধরায় যদি অন্যন্য মাছের ক্ষতি হয়, তাহলে কাঁকড়া বেশী ধরায় একদিন কি এই কাঁকড়াও হারিয়ে যাবে? যদি তাই হয়, তাহলে সুন্দরবনতো প্রাকৃতিক উপায়ে দূষণমুক্ত রাখার প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হবে। কাঁকড়াতো সুন্দরবনের মধ্যেকার নদী-নালা-খালের পানি পরিষ্কার রাখে। (চলবে)

খুলনা গেজেট/ টি আই




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!