খুলনা, বাংলাদেশ | ২৪শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৮ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ৩ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৪২৫

ভাঙ্গন কবলিত খোলপেটুয়া নদী থেকে বালু উত্তোলন, বাড়ছে বেড়িবাঁধ ভাঙ্গন

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা

সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকা শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলাধীন খোলপেটুয়া নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় ও বহিরাগত একাধিক বালু ব্যবসায়ী বাণিজ্যিকভাবে বিক্রির জন্য ড্রেজার মেশিন দিয়ে প্রতিনিয়ত বালু উত্তোলন করছে। এভাবে উত্তোলিত বালু নওয়াবেকী বাজারসহ বেশকিছু জায়গায় গুদামজাতের পাশাপাশি বিভিন্ন ঠিকাদার ও ব্যক্তির চাহিদামতো সরবরাহ করা হচ্ছে।

এভাবে ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় জেলার আশাশুনি উপজেলার বিছট, নয়াখালী, কাকবসিয়া, কোলা-ঘোলা, হাজরাখালী, পুইজালা, হরিষখালী, প্রতাপনগর ও শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, পদ্মপুকুর ও বন্যতলাসহ বিভিন্ন স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধে ভাঙ্গন দেখা দিচ্ছে। কোন কোন স্থানে বাঁধের ভাঙ্গন ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে যে কোন জলোচ্ছ¡াসে বা নদীতে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেলে ক্ষতিগস্ত এসব বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে।

স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের নাকের ডগায় দীর্ঘদিন ধরে এভাবে বালু উত্তোলন চললেও কেউ ‘টু’ শব্দটি পর্যন্ত করছে না। সাতক্ষীরা শহরের একজন প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় বারবার ভাঙ্গনের মুখে পড়া এলাকা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। বিষয়টি দেখেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে প্রশাসন, এমনকি পাউবো’র সংশ্লিষ্টরা পর্যন্ত অজ্ঞাত কারণে নীরবতা পালন করছেন বলে অভিযোগ এলাকাবাসির। দুর্যোগপ্রবণ অংশ থেকে টানা বালু উত্তোলনের ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে বেড়িবাঁধ ভাঙ্গন আতঙ্ক বাড়ছে।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, খোলপেটুয়া নদীতীরবর্তী আশাশুনি উপজেলার কোলা-ঘোলা, কল্যানপুর, বিছট খেয়াঘাট এলাকা, শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী, বিড়ালাক্ষী, পাখিমারা ও নেয়াবেকি এলাকায় মাঝ নদীতে একাধিক ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ছোট কাঠের নৌকা ও কার্গো মধ্যে বসানো ওই মেশিনের সহায়তায় নদীর গভীর থেকে বোরিং করে বালু উত্তালন করা হচ্ছে। একই সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে নেওয়া হচ্ছে নেয়া হচ্ছে এসব বালু। বহিরাগত ও স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী খুলনার কয়রা এবং পাশের এলাকাগুলো থেকে ড্রেজার মেশিন আর কার্গোসহ ভাড়াটে শ্রমিক এনে নির্দিষ্ট অঙ্কের চুক্তিতে এসব বালু উত্তোলন করছে।

বালু উত্তোলনের কাজে জড়িত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উত্তোলনসহ নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দিতে দূরত্বভেদে বালু ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতি ফুট চার থেকে ছয় টাকা দিচ্ছে। পরে ওই বালু ফুটপ্রতি আট থেকে ১৪ টাকায় বিক্রি করছেন তারা। বালু ব্যবসায়ীদের দেখিয়ে দেওয়া অংশ থেকে তারা ‘হুকুমের গোলাম’ হিসেবে বালু উঠিয়ে দিচ্ছে বলেও তাদের দাবি।

স্থানীয়দের দাবি, ভাঙ্গনকবলিত এলাকা হওয়ায় মানুষের দৃষ্টি এড়াতে রাতের আঁধারে বালু উত্তোলন করছে সংশ্নিষ্টরা। স্থানীয় তহশিল অফিস, ঊর্ধ্বতন প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিরা অজ্ঞাত কারণে চুপ থাকায় মাসের পর মাস তারা বালু উত্তোলন অব্যাহত রেখেছে। বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িতরা এলাকায় প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের কারও নাম কেউ মুখে আনতে চায় না। নদী থেকে বালু উত্তোলন করে একাধিক আড়তে গুদামজাতের পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন প্রান্তে তা সরবরাহ করা হচ্ছে। জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় প্রশাসনকে নানাভাবে ম্যানেজ করে তারা দীর্ঘদিন ধরে ভাঙ্গন স্থান থেকে বাধাহীন ভাবে বালু উত্তোলনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বলেও দাবি তাদের।

ক্যামনগরের বিড়ালাক্ষী গ্রামের একাধিক লোক জানান, গত এক যুগে অন্তত আটবার তাদের বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে চিংড়ি চাষের ঘের প্লাবিত হয়েছে।

আশাশুনির বিছট গ্রামের আব্দুল হাকিম মোড়ল জানান, অব্যহত নদী ভাঙ্গনে বিছট গ্রামের শতাধিক পরিবার বসতভিটা হারিয়ে এখন পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধের পাশে বসবাস করছে। অনেকে সহায় সম্বল হারিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে অন্যত্রে। শতাধিক বিঘা ফসলি জমি চলে গেছে খোলপেটুয়া নদীর গর্ভে। গত কয়েকদিন আগেও বিছট মোড়ল বাড়ির সামনে বেড়িবাঁধে ভাঙ্গন দেখা দেয়। স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে কোন রকমে তা টিকিয়ে রেখেছে। কোলা-ঘোলা, কল্যানপুর, বিছট খেয়াঘাট এলাকা থেকে অব্যহত ভাবে বালু উত্তোলনের কারনে বিছট গ্রামে বেবিাঁেধর ভাঙ্গন কোন ভাবেই রক্ষা করা যাচ্ছে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন জানান, নওয়াবেকী এলাকার ফারুক এবং রবিউল খোকন বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত ।

বালু উত্তোলনের কাজে ব্যবহৃত কার্গোসহ যাবতীয় সরঞ্জাম নিজের নিশ্চিত করে ফারুক হোসেন জানান, সাতক্ষীরার এক ব্যবসায়ী ইজারা নেওয়া খোলপেটুয়া নদীর চর থেকে তাকে বালু উত্তালনের কাজ দিয়েছে। তার নওয়াবেকী গুদামের বালু ভাঙ্গনকবলিত এলাকা থেকে সংগৃহীত নয় বলেও তিনি দাবি করেন।

বালু উত্তোলনের কাজের সঙ্গে জড়িত রবিউল খোকন বলেন, প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। তবে দূরের বালুমহালের অনুমতি থাকলেও যত্রতত্র বোরিং করে বালু উত্তোলন করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি আর কোন কথার উত্তর দেননি ।

তবে স্থানীয়দের দাবি, সাতক্ষীরার আশাশুনির চর বালুমহাল ঘোষণা সত্তে¡ও বেশি মুনাফার লোভে প্রভাবশালীরা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ভাঙ্গনকবলিত খোলপেটুয়া নদী থেকে বালু উত্তোলন করছে। এদিকে ব্যবসায়ীরা ভাঙ্গনকবলিত এলাকার বালুকে বালুমহালের বলে চালিয়ে দিচ্ছে।

এ বিষয়ে পরিবেশ নিয়ে আন্দোলন কারি মিসেস শামিমাজামান জানান, নদীভাঙ্গনের ফলে প্রতি বছর শ্যামনগরের উপকূলীয় এলাকার অসংখ্য পরিবার গৃহহীন হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। তারপরও নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ করা না হলে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি উপকূল রক্ষা বাঁধ কোনোভাবেই টিকবে না।

শ্যামনগর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, নদীর চর থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়টি আমাদের জানা নেই । এ নিয়ে তাদের কেউ অবহিত করেনি। এমনটি হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। জড়িতদের ধরতে পারলে আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানান তিনি।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!