খুলনা, বাংলাদেশ | ১৭ কার্তিক, ১৪৩১ | ২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  আজ সাফজয়ী নারী ফুটবল দলকে সংবর্ধনা দেবেন প্রধান উপদেষ্টা

ভয়ঙ্কর সেই রাত !

আয়শা আক্তার জ্যোতি

দিনটা ছিলো বৃহস্পতিবার। প্রতিদিনের মতো সেদিনও অফিসে গিয়ে নিজের কাজ শেষ করি। আমি ঝটপট হাতের কাজ শেষ করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেই। রাতে চলাচল করা আমার যেনো অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া গাড়িতে বসে রং-বে-রঙের আলো দেখা, জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস, হাতে একটা উপন্যাসের বই আর কানে হেডফোন। ফিসফিস করে হাতে থাকা উপন্যাস শোনা এ যেনো এক অন্য রকম অনুভূতি। গাড়ির ভিতরে বসে মনে করছিলাম বিগত এক মাসে কি কি হল। কিভাবে কাটালাম এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন সাত ঘন্টার জার্নি শেষ করে আমার গ্রামের বাজারে এসে পৌঁছালাম বুঝতে পারিনি। গাড়ি থেকে নেমেই দেখি বাজারের বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ। বাজারে লোকজনও খুব বেশি একটা নেই।

যেহেতু রাত গভীর হচ্ছে, তাই গ্রামের দিকটা শুনশান অবস্থা। ভ্যানও ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। আমি একা একটা ভ্যানে দশ মিনিট ধরে বসে আছি, আরো এক দুই জনের জন্য অপেক্ষায় চালক। অবশেষে একটা ছেলে তাড়াহুড়ো করে এসে ভ্যানে উঠলো আর বললো চাচা চলেন। ভ্যানওয়ালা চাচা এমনভাবে চালাচ্ছিলেন বা পাশে বসা ছেলেটার পায়ে চোট লাগার মত অবস্থা। তখন ছেলেটির জোর গলায় বলে চাচা সাবধানে চালান। আমি তখন চাঁদ দেখায় ব্যস্ত। কয়েক বছর হল মনভরে চাঁদ দেখি না। ইট পাথরের শহরে ক্লান্ত-ভরা চোখ নিয়ে আর চাঁদ দেখাটা আমার হয়ে ওঠে না। যাইহোক ছেলেটার কথায় আমার ঘোর ভাঙলো। আমি বললাম চাচা সাবধানে চালান, আস্তে আস্তে যান।

বলে রাখা ভালো আমাদের গ্রামে ভয় একটু বেশি। কারণ শুনেছি আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের সময় নাকি অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল। তাছাড়া আত্মহত্যার প্রবণতা ও আমার গ্রামে একটু বেশি। তাদের অতৃপ্ত আত্মা সবাইকে তাড়া করে বেড়ায়। আমরা আজকে যে ভ্যানে উঠেছিলাম ঐ ভ্যানওয়ালা চাচার বর্ণনা একটুখানি বলি। চাচার বয়স প্রায় ৫৫ এর কাছাকাছি। চুল-দাড়ি একদম সাদা, পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরা।

ছেলেটি: চাচা সখীপুর যাবেন?

চাচা: না ওইদিকে যামু না।

আমি: চাচা আমিও যাবো চলেন। আমাকে না হয় একটু ভিতরে নামিয়ে দিয়েন।

ছেলেটির সাথে কথা বলতে বলতে কি একটা কথা নিয়ে চাচা হঠাৎ করে বসন্তপুর নামটা বলে উঠলো।

আমি: চাচা বসন্তপুর কোথায়?
[চাচাকে তিনবার প্রশ্ন করার পর]

চাচা: কেন জানেন না কৈলাস কাটির আগে।

আমি: আমি তো এই গ্রামের মেয়ে। জানিনা তো কৈলাস কাটির আগে বসন্তপুর নামে কোন গ্রাম আছে।

আমার পাশে বসা ছেলেটি: আপু আপনার বাসা কোথায়?

আমি: সখিপুরের পাশে শ্রীরামপুর। এইভাবে আমার আর তথার কথা শুরু হল।

ও ভালো কথা ওই ছেলেটির নাম বলতেই ভূলে গেছি, ছেলেটির নাম তথা। তথা সখিপুর গ্রামের ছেলে। পেশায় সে একজন ব্যাংকার। কথা বলতে বলতে খেয়াল করি তথা কি একটা নিয়ে খুব চিন্তায় আছে আর ব্যাগটাকে আঁকড়ে ধরে আছে। তথা এতটাই চিন্তা করছিল যে ঘাম বোঝা যাচ্ছিল। আমার ব্যাগে থাকা পানির বোতল ও একটা টিস্যুও তথাকে এগিয়ে দিলাম। এরপর দুজনের কথাবার্তা মাধ্যমে জানতে পারলাম তথা আমার কাকির মামাতো ভাই। সম্পর্কে আমার আত্মীয়। আমরা যখন কথাবার্তার মাধ্যমে গ্রামে প্রবেশ করছিলাম তখন ভ্যানওয়ালা চাচার কথাবার্তা কিছুটা অসংলগ্ন ছিল। কিন্তু আমি ও তথা আমাদের কথায় এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে চাচার কথাগুলোকে তখন গুরুত্বই দেইনি। তথার সাথে কথা বলতে বলতে ৫৫ মিনিটে রাস্তা শেষ করে প্রায় ১২টার দিকে আমার গ্রামে পানা পুকুরের কাছে পৌঁছে দেখি আমার বাবা দাড়িয়ে আছে। আমি তথাকে বাই বলে ভ্যানওয়ালার চাচার টাকা মিটিয়ে পানা পুকুরের ভাঙ্গা রাস্তা দিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।

মিনিট পাঁচ হাঁটার রাস্তা শেষ করে বাড়িতে ঢুকতে যাবো ঠিক তখন তথার কল। কলটা রিসিভ করে

আমি: তথা আমি বাড়িতে মাত্র পৌঁছালাম। কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে কোনো কথা আসছে না।

আমি: তথা, হ্যালো, হ্যালো, তথা,,,,,

হঠাৎ একটা চিৎকার দিয়ে তথা বলে উঠলো আমাকে মাফ করে দেও। কে তুমি? আমাকে তুমি ছেড়ে দেও।

তখন আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে ঐ ভ্যানওয়ালা চাচা সাধারণ কেউ না। আমি, বাবা, ভাই আর কাকাদের ডেকে দৌড়ে সখিপুর ঢুকতে বড় বটগাছের নিচে যায়। আর সেখানে পৌঁছেই তথাকে কোথাও দেখতে পাই না। তবে হ্যা সেখানে থেকে আমরা যখন সখিপুরের দিকে যাব ঠিক তখনই আমার কাকা একটা ব্যাগ ও জুতা দেখতে পেয়ে আজান দিতে শুরু করে। আজানের ঠিক শেষের সময় তথাকে আমরা বট গাছের নিচে দেখতে পাই। কাকা আজান শেষ করে সূরা পড়ে পানিতে ফুঁ দিয়ে দেয়। ঐ পানি তথার মুখে ছিটিয়ে দিলে তথা জ্ঞান ফিরে আসে। তখন খেয়াল করে দেখি তথা বাম পায়ের নিয়ে দুটো দাঁতের এবং সারা গায়ে অসংখ্য নকের আঁচড়ের দাগ। তাকিয়ে দেখি ততক্ষণে বটতলায় লোকের ভিড় জমে গিয়েছে। ভিড়ের মধ্যে একজন তথাকে চিনতে পেরে তথার বাড়িতে ফোন করে খবর দিয়েছে। তার কিছুক্ষণ পরে তথার বাবা, মা ও ভাইয়া এসেছে। আঙ্কেল ও আন্টি তথাকে দেখে ভেঙে পড়ে। আমি ভাইয়ার কাছে তথার ব্যাগটা দিয়ে সব ঘটনা খুলে বলি। এরপর ভাইয়া তথাকে নিয়ে চলে যায়। আমরা সবাই ফিরে আসি। এর পরের দুই দিন তথাকে বারবার কল দিয়েও পাওয়া যায়নি।

এইভাবে কেটে গেলো পাঁচটা দিন। এইবার আমার ফেরার পালা। ফেরার পথে বাবার সাথে তথাদের বাড়িতে যায় তথার সাথে দেখা করতে, খোঁজ নিতে। তথাকে দেখার পরে আমি নিজেকে প্রশ্ন করি আমি কি প্রস্তুত ছিলাম তথাকে এইভাবে দেখার জন্য? না ছিলাম না। সে রাতে অনেক কষ্টে তথাকে ফিরিয়ে আনতে পারলেও তথা সবাইকে ভুলে গিয়েছে। নিজেকে সে হারিয়েছে অন্য রকম এক রঙিন দুনিয়ায়। তথা এখন ঠিক বাচ্চাদের মতো ব্যবহার করে। আন্টি কাঁদতে কাঁদতে বলে আমার তথা পাগল হয়ে গেছে, মা আমার তথা পাগল হয়ে গেছে। সেদিন তোমার আমার তথাকে কোনরকমে জানে ফেরাতে পেরেছিলে। ওরা তো আমার তথাকে মেরে ফেলার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল। আমার তথা শুধু জানে বেঁচে আছে, আর কিছু নেই।

আমাকে ফিরতে হবে। গাড়িরও সময় হয়ে যাচ্ছে। আন্টির কান্না জড়ানো আহাজারি, তথার অবাক চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকানো আমাকে যেনো ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। বাবা আমাকে অনেক গুলো কথা বলে গাড়িতে তুলে দিলো। আজকেও জানালার পাশে বসেছি। কিন্তু আজকে আর উপন্যাস শুনতে পড়তে একদমই ভালো লাগছে না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি ঠিকই বাইরের সব রং গুলো কেনো জানি সাদা মনে হচ্ছে। বাইরে তাকিয়ে তথার বলা কথা মনের মধ্যে বারবার উকি দিচ্ছে। জীবন কতটা অদ্ভুত তাই না। যেদিনটা যাচ্ছে সেটা ভালো আর যেদিন টা আসছে সেটা ভয়ের, সেটা আতঙ্কের। ভালো থেকো এই শহরে মধ্যে থাকা রং হিন মানুষ গুলো। ভালো থেকো তথা।

খুলনা গেজেট/এএজে




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!