২০১৯ সালের নভেম্বর মাসের ৮ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত দুই দিনের সরকারি ছুটি চলাকালীন সময়ে বেনাপোল কাস্টমসের সুরক্ষিত লকার থেকে স্বর্ণের বার চুরির ঘটনা ঘটে। কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীতে থাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে থাকা ১৯ কেজি ৩শ গ্রাম স্বর্ণেরবার চুরি হয়ে যায়। মামলার আলামত হিসেবে জব্দ হওয়া এসব স্বর্ণের বার চুরির ঘটনায় সে সময়ে কাস্টমসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি বেশ জোরেশোরে আলোচনায় আসে। তবে সিআইডি পুলিশের তদন্তে কাস্টমসের রাঘববোয়ালদের কারোর নাম উঠে আসেনি।
বরং অভিযোগ উঠেছে, চুরি হওয়া সেই স্বর্ণের বার উদ্ধার না করেই রাঘববোয়ালদের আড়ালে রেখে অনেকটা ধীরগতির তদন্ত শেষে কাস্টমস হাউজের ৫ জন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও ২ জন আউট সোর্সিং কর্মচারীদের অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশীট দেয় সিআইডি পুলিশ। মামলাটি বিচার কাজ শুরু হলেও এর গতি নিয়েও দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের সর্ববৃহৎ স্থল বন্দর বেনাপোলের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সোনাসহ মূল্যবান সম্পদ পাচার হয়ে আসছে। একটি প্রভাবশালী চোরাকারবারী সিন্ডিকেট এ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়। এসব সোনা ও মূল্যবান সম্পদের ছোট-বড় চালান মাঝে মধ্যে সীমান্তে নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে সেগুলো নিরাপত্তার স্বার্থে কাস্টম হাউজের সুরক্ষা লকারে মামলার আলামত হিসেবে রাখা হয়।
সিআইডি পুলিশ কাস্টমস হাউজের ৫ জন রাজস্ব কর্মকর্তা ও ২ জন আউট সোর্সিংয়ের কর্মচারীকে গ্রেফতার করে। তবে আজও পর্যন্ত চুরি হওয়া স্বর্ণের বার উদ্ধার ও এর নেপথ্যে থাকা কাস্টমসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে পারেনি সিআইডি পুলিশ। যেকারণে এ নিয়ে বেনাপোল বন্দর কেন্দ্রিক ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে বেনাপোল সিএন্ডএফ এজেন্ট নাজিম উদ্দীন বলেন, বেনাপোল কাস্টমস ভবন একটি সুরক্ষা প্রাচীরে ঘেরা। সেই কাস্টমস ভবনের সরকারি লকারে থাকা এসব স্বর্ণের বার চুরির ঘটনা কাস্টমসের শীর্ষ কর্মকর্তারা দায় এড়াতে পারেনা। তিনি বলেন, আমরা ব্যবসায়ীরা প্রত্যাশা করেছিলাম চুরি হওয়া স্বর্ণের বার উদ্ধার হবে এবং এর নেপথ্যেও গড ফাদারদের মুখোশ উন্মোচন হবে। কিন্তু তা না হয়ে কাস্টমসের কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে অভিযুক্ত করে মামলার চার্জশীট দেয়া হয়েছে। এতে করে কাস্টমসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সেভ করা হয়েছে বলে এই ব্যবসায়ী নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
মামলা তদন্ত ও তার স্বচ্ছতার বিষয়ে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের দাবি দূর্বল কাঠামো দিয়ে মামলাটি আদালতে বিচারের জন্য উপস্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে প্রকৃত আসামীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেলো।
এ বিষয়ে যশোর জেলা দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, চাঞ্চল্যকর এ মামলাটির বিচারকাজ আদালত শুরু করেছে। হয়তো বিচারও হবে। তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে এমন বড় কেলেঙ্কারীর সাথে কারা জড়িত। কী করে এটি সম্ভব হলো। এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে অবশ্যই মামলাটির সঠিক তদন্ত হওয়া উচিৎ। না হলে এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি আরো বলেন, বেনাপোল কাস্টমস হাউস থেকে স্বর্ণগুলো চুরি হয়নি বরং আত্মসাত করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চুরি হওয়া মালামাল উদ্ধার না করে আদালতে চার্জশীট প্রদানের বিষয়ে সিআইডি পুলিশ যশোরের পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ মহিউদ্দীন বলেন, মামলাটি যথাযথ স্বচ্ছতার সাথে তদন্ত সাপেক্ষে ৭ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশীট দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম করা হয়নি বলে তিনি জানান।
এদিকে চাঞ্চল্যকর এ মামলার বিচার কাজের গতি নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ২০২১ সালের ২৯ এপ্রিল সিআইডি পুলিশ আদালতে চার্জশীট দাখিলের পর পরবর্তীতে ২০২২ সালের ২২ এপ্রিল বিচারের জন্য চার্জগঠন করে যশোর চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ১ম আদালতের বিচারক। বর্তমান মামলার ৩৪ স্বাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৫ জনের স্বাক্ষ্যগ্রহণ করা হলেও বাকি ২৯ জন স্বাক্ষীর স্বাক্ষ্য কবে নাগাদ গ্রহণ করা হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে যশোর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ইদ্রিস আলী বলেন, বেনাপোল কাস্টমস হাউজের লকারের স্বর্ণ চুরির ঘটনাটি যশোর চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ১ম আদালতে বিচার কাজ শুরু হয়েছে। আশা করছি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এ মামলার বিচার কাজ শেষ করে আসামীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
খুলনা গেজেট/ টিএ