খুলনা, বাংলাদেশ | ২০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী : রায় কবে জানা যাবে আজ

প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে কিছু কথা

ডা. হিমেল ঘোষ

প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় শনিবার হিসাবে ১২ সেপ্টেম্বরকে ফার্স্ট এইড ডে বা প্রাথমিক চিকিৎসা দিবস হিসাবে পালন করা হচ্ছে। দুর্ঘটনাজনিত বা অন্য যেকোনো কারণে আরো গুরুতর শারীরিক ক্ষতিগ্রস্ততা ও সঙ্কটাপন্ন হবার হাত থেকে রোগীকে বাঁচাতে প্রাথমিক চিকিৎসা অত্যন্ত ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রাথমিক চিকিৎসা তথা ফার্স্ট এইডের মূল লক্ষ্যই হলো তাৎক্ষণিক ত্বরিত ব্যবস্থাপনায় অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুহার হ্রাস করা। আহতদের জীবন রক্ষার চেষ্ঠা করা ও চিকিৎসায় সহযোগিতা করা এবং রােগী বা আহত ব্যক্তির অবস্থার অবনতি রােধ করা হল প্রাথমিক চিকিৎসার মূল ভিত্তি।

যেকোনো ভাবেই হোক না কেন, অসাবধানতাবশত ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা। অনেকসময় প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিগণ সচেতন থাকলেও শিশুরা খেলাচ্ছলেই ঘটিয়ে ফেলতে পারে ছোটখাটো নানা দুর্ঘটনা। এইসকল বিরূপ পরিস্থিতি সামাল দিতে দরকার প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞান, যেমন –
ছোটখাটো কাটাছেঁড়া হলে : অল্প ও অগভীর কাটাছেঁড়ার প্রাথমিক চিকিৎসা ঘরে বসেই করা সম্ভব। কাটাছেঁড়া থেকে রক্ত বের হলে প্রথম কাটা জায়গাটি পরিষ্কার কাপড়ের টুকরো দিয়ে চেপে ধরে রাখুন কয়েক মিনিট। রক্তপাত কিছুটা কমে এলে তুলায় অ্যান্টিসেপটিক দ্রবণ লাগিয়ে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করুন। এরপর ব্যান্ডেজ দিয়ে হালকাভাবে বেঁধে রাখুন। খেয়াল রাখুন, ক্রমাগত রক্তপাত হতে থাকলে অথবা ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হলে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে যেতে হবে।

শরীরের কোথাও পুড়ে গেলে : ঘরোয়া দুর্ঘটনার মধ্যে অন্যতম সাধারণ সমস্যা হল ত্বক পুড়ে যাওয়া। গরম পানির ভাপ, যেকোনো ধরনের গরম তরল অথবা সরাসরি আগুনের স্পর্শে ত্বক পুড়ে যেতে পারে। ত্বক পুড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত স্থান পানির কল ছেড়ে প্রবহমান পানির ধারার নিচে রাখুন অন্তত ১০ মিনিট। সেই সঙ্গে রোগীকে এক প্যাকেট ওরস্যালাইন গুলে খেতে দিন। কারণ পুড়ে গেলে শরীরে পানির স্বল্পতা দেখা দেয়। এরপর পোড়া স্থান শুকনো কাপড় দিয়ে হালকাভাবে মুছে এর পরিমাণ ও গুরুত্ব বুঝে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হবে। অল্প ক্ষত হলে কিংবা হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন হলেও প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে ক্ষতস্থানে পুরু করে বার্ন ক্রিম (১% সিলভার সালফাডায়াজিন) লাগিয়ে দিন। হাতের কাছে মলম না থাকলে ডিমের সাদা অংশ অথবা মধুও লাগাতে পারেন। মধু ও ডিমের সাদা অংশে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপটিক থাকে।

কোনো পোকা কামড়ালে : পোকা কামড়ানোর ক্ষতস্থানটি যত দ্রুত সম্ভব সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। ব্যথার স্থানে বরফ সেঁক দিন। ২.৫% কিটোপ্রোফেন মলমও লাগাতে পারেন। মলম না থাকলে কাঁচা হলুদের রস বা হলুদ গুঁড়া গুলে লাগাতে পারেন। এক জায়গায় বেশি কামড় দিয়েছে কি না, সেদিকে খেয়াল করুন। ক্ষত বেশি হলে বা শ্বাস নিতে কষ্ট হলে কিংবা জিহ্বা ও গলা ফুলে উঠলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

সাপে দংশন করলে : আমাদের দেশের বিষধর সাপের প্রজাতি ও সংখ্যা খুব কম। সাধারণত সাপের কামড়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ৯৫ শতাংশ সাপই বিষধর নয়। এসব সাপের কামড়ে রোগীর কোনো ক্ষতি হয় না। বিষধর সাপের কামড়ের লক্ষণ হলো ক্ষতস্থানে দুইটা বিষদাঁতের দংশনের চিহ্ন থাকবে এবং রোগীর শরীর অবশ হয়ে আসবে কিংবা হাত-পা নাড়াতে পারবে না, চোখ ভারি হয়ে আসবে, ঘুম ঘুম ভাব অনুভূত হবে, বমি হবে অথবা ক্ষতস্থান থেকে অনবরত রক্ত ঝরতে থাকবে। বিষধর সাপে কাটলে প্রথমে শুকনো লম্বাটে কোনো কাপড় দিয়ে আক্রান্ত স্থানের খানিকটা ওপরে হালকাভাবে বাঁধতে হবে। এক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় দড়ি বা রশি দিয়ে এত শক্ত করে বাঁধা হয় যে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে হাত-পায়ের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হয়ে যায়। তাই সাপে কামড়ালে কাপড়ের টুকরো দিয়ে এমনভাবে বাঁধতে হবে, যেন বাঁধনের ভেতর দিয়ে দুটি আঙুল ঢোকানো যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগী আতঙ্কিত হয়ে ভয় পেয়ে যায়। রোগীকে একগ্লাস গ্লুকোজ, শরবত বা খাবার স্যালাইন গুলে খাওয়ানো যেতে পারে। এরপর রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে।

ডায়াবেটিক রোগী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলে : ডায়াবেটিস হলে রোগীকে খাবারে শর্করা খুব মেপে খেতে বলা হয়। এ ক্ষেত্রে কখনো কখনো রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেশি কমে গেলে রোগী অতিরিক্ত ঘেমে ও বুক ধরফর করে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেশি মাত্রায় কমে গেলে রোগীর মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়ে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। এমন অবস্থায় ঘাবড়ে না গিয়ে রোগীকে চিনি বা চিনিজাতীয় খাবার যেমন- চিনি বা গুড়ের শরবত, চকোলেট খাওয়াতে হবে। তরল খাওয়ানো সম্ভব না হলে খানিকটা চিনির দানা রোগীর মুখে দিয়ে দেওয়া যায়। এতে কয়েক মিনিটের মধ্যে রোগীর জ্ঞান ফিরে আসবে। যদি জ্ঞান না ফেরে, তাহলে যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতালে নিতে হবে।

পানিতে ডুবে গেলে : কেউ পানিতে ডুবে গেলে আতঙ্কিত না হয়ে প্রথমে তাকে তুলে নিয়ে আসুন। ডুবন্ত কাউকে সাহায্য করতে গেলে সাবধান থাকতে হবে। কারণ, ডুবন্ত ব্যক্তি উদ্ধারকারীকে সজোরে জড়িয়ে ধরে। ফলে দেখা দিতে পারে বিপত্তি। এ জন্য ডুবন্ত ব্যক্তিকে পেছন থেকে হাতসহ জড়িয়ে ধরে পানি থেকে তুলতে পারেন। পানি থেকে তোলার পর উপুড় করে দেখতে হবে শ্বাস-প্রশ্বাস আছে কি না। ডুবন্ত ব্যক্তির নাম ধরে ডাক দিয়েও দেখা যেতে পারে তিনি সাড়া দেন কি না। যদি শ্বাস-প্রশ্বাস না থাকে বা শ্বাস নিতে কষ্টকর হয়, তাহলে খেয়াল করতে হবে যে শ্বাসনালির কোথাও কিছু আটকে আছে কি না। এ জন্য আঙুল দিয়ে মুখের মধ্যে কাদা-মাটি থাকলে বের করে দিতে হবে। তার পরও শ্বাস না নিলে মাথা টানটান করে ধরে মুখ হাঁ করাতে হবে। এবার উদ্ধারকারী ব্যক্তিকে পেট ভরে শ্বাস নিতে হবে। ডুবন্ত ব্যক্তির মুখের সঙ্গে মুখ এমনভাবে লাগাতে হবে যেন কোনো ফাঁকা না থাকে। শিশু বা কম বয়সী হলে নাক-মুখ একসঙ্গে মুখের মধ্যে পুড়তে হবে আর বয়স্ক ব্যক্তি হলে নাক হাত দিয়ে চেপে ধরে মুখে মুখ লাগাতে হবে। এ অবস্থায় উদ্ধারকারী জোরে শ্বাস নিয়ে ডুবন্ত ব্যক্তির মুখে মুখ দিতে হবে। দেখতে হবে যে শ্বাস দেওয়ার ফলে ডুবন্ত ব্যক্তির পেট ফুলে যায় কি না। যদি পেট ফুলে যায়, তাহলে বোঝা যাবে শ্বাস দেওয়া ঠিকমতো হচ্ছে। ডুবন্ত ব্যক্তি নিজে থেকে শ্বাস না নেওয়া পর্যন্ত এমন চলতে থাকবে।

হাত ধরে বা গলার পাশে হাত দিয়ে দেখতে হবে যে নাড়ির স্পন্দন আছে কি না। যদি না থাকে, তাহলে বুকে চাপ দিতে হবে। বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে জোরে জোরে চাপ দিতে হবে যেন বুক বেশ খানিকটা দেবে যায়। যদি শিশু এক থেকে দুই বছরের হয়, তাহলে শিশুর বুক দুই হাত দিয়ে ধরে বুড়ো আঙুল দিয়ে চাপ দিতে হবে। এভাবে প্রতি ত্রিশবার চাপ দেওয়ার পর আগের মতো দুইবার করে শ্বাস দিতে হবে। নাড়ির গতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এরকম চালাতে হবে। এছাড়া প্রাথমিক চিকিৎসা চলার পাশাপাশি দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। শিশু পানিতে থাকার কারণে শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়। তাই শরীর গরম রাখার জন্য কাপড়চোপড় দিয়ে ভালো করে ঢেকে রাখা উচিত।

ডুবন্ত ব্যক্তির মুখের সঙ্গে মুখ এমনভাবে লাগাতে হবে যেন কোনো ফাঁকা না থাকে। শিশু কম বয়সী হলে নাক-মুখ একসঙ্গে মুখের মধ্যে পুড়তে হবে আর বেশি বয়সী হলে নাক হাত দিয়ে চেপে ধরে মুখে মুখ লাগাতে হবে। এ অবস্থায় উদ্ধারকারী জোরে শ্বাস নিয়ে ডুবন্ত ব্যক্তির মুখে মুখ দিতে হবে। দেখতে হবে, শ্বাস দেওয়ার ফলে ডুবন্ত ব্যক্তির পেট ফুলে যায় কি না। যদি পেট ফুলে যায়, তাহলে বোঝা যাবে শ্বাস দেওয়া ঠিকমতো হচ্ছে। ডুবন্ত ব্যক্তি নিজে থেকে শ্বাস না নেওয়া পর্যন্ত এমন চলতে থাকবে।
কেউ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে : কারো শরীরে বিদ্যুতের তার জড়িয়ে গেলে বা কেউ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে সাথে সাথে মেইন সুইচ বন্ধ করে দিতে হবে। কোনো কারণে সুইচ বন্ধ করতে না পারলে শুকনাকাঠ দিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে ছাড়িয়ে দিতে হবে। কাঠ না পেলে শুকনা কাপড় হাতে জড়িয়ে ধাক্কা দিতে হবে। কিন্তু কখনো খালি হাতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ব্যক্তিকে ধরা যাবে না। খালি হাতে ধরলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে উদ্ধারকারীরও বিপদ ঘটতে পারে। কখনো বিদ্যুতাহিত ব্যক্তির গায়ে পানি দেওয়া যাবে না। রোগীর শ্বাসক্রিয়া না চললে কৃত্রিমভাবে শ্বাসকার্য চালাতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

হাড় ভেঙে গেলে : শরীরের কোন স্থানের হাড় ভেঙে গিয়েছে বলে সন্দেহ করলে প্রথমেই আক্রান্ত অংশটিকে বিশ্রামে রাখতে হবে। পাশাপাশি ঐ স্থানে বরফ লাগানো যেতে পারে। ক্রেপ ব্যান্ডেজ দিয়ে আক্রান্ত অঙ্গের নড়াচড়া বন্ধ করতে হবে। আক্রান্ত অঙ্গটি একটু উঁচুতে রাখতে হবে যেন অঙ্গটি হৃৎপিণ্ডের অবস্থান থেকে ওপরে থাকে। এরপর যত দ্রুত সম্ভব আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

এভাবে আপনার সামান্য একটু সচেতনতা এবং প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞানই পারে কোন বিপদগ্রস্থ ব্যক্তিকে উদ্ধার করে তাঁকে মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচাতে।

লেখক : এমবিবিএস(ঢাকা মেডিকেল কলেজ), বিসিএস(স্বাস্থ্য),
মেডিকেল অফিসার,
উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ডুমুরিয়া, খুলনা।

 

খুলনা গেজেট / এমএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!