খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  মার্কিন শ্রম প্রতিনিধি দল ঢাকা আসছে আজ

প্রতিভা ও সাহিত্য বিকাশে মানুষের অবদান

নাসরিন নাজ

প্রতিভা নিয়ে মানুষ জন্মায় না, মূলত অর্জন করতে হয়। প্রতিভা অর্জন করার প্রধান শর্তই হলো পরিশ্রম এবং নিষ্ঠা। আজকের একবিংশ শতাব্দীর পাদদেশে দাঁড়িয়ে আমরা অনুমান করতে পারি যে, প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে হাজার হাজার বছরের অভিজ্ঞতায় এবং অধ্যাবসায়ে অসংখ্য পরীক্ষা নিরীক্ষা ও প্রক্রিয়ার ফলে আমরা আজ এই আধুনিক সভ্যতায় পৌঁছতে পেরেছি। আত্মরক্ষার তাগিদেই মানুষ প্রথম ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ফলে সৃষ্টি হয়েছিল দল বা গোষ্ঠীর। ক্রমশ অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান ও রীতি নীতিকে সুসংহত করবার প্রয়োজন বোধ থেকে আসে সমাজ চিন্তা, সমাজ বন্ধন।

মানুষ ক্রমাগত দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে। সেই থেকে আমাদের উন্নতি বা অগ্রগতির যাত্রা শুরু। আর জাতীয় জীবনের পরিণত রূপকেই বলা চলে সভ্যতা। এই সভ্যতাকে ধারণ ও বহন করবার জন্য মানুষ গড়েছে শিল্পকৃষ্টি; রচনা করেছে সাহিত্য। সাহচার্য্য বাসহিতত্ব কথাটি সহিত তত্ত্বের অপভ্রংশ হিসাবে এসেছে বলে মনে করা হয়। আর এই উৎস হল ‘স-হিত’ অর্থাৎ কল্যাণের সঙ্গে সাহিত্যের তাৎপর্য্য নিহিত। সাহিত্য কেবল মানুষের সমাজ ও সভ্যতাকে ধারণ ও বহনই করে না; নতুনের দিকে ও বিকাশের পথে এগিয়ে দেয়। সেই কারণে, বিবর্তন ও বিকাশের ধারাবাহিকতা বিশ্বময় অব্যাহত রয়েছে।

প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার যে, মানুষের জন্যই সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। এই সাহিত্য সম্বন্ধে বিদগ্ধজনের বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত হয়েছে। কারো মতে, সাহিত্যে রূপ ও রস সৃষ্টি হয়, কেবল রসস্বাদনের জন্য। অন্য মতে, সাহিত্য সমাজের দর্পনস্বরূপ অর্থাৎ সমাজে যা কিছু ঘটে, মানুষের ভাল মন্দ, সুন্দর অসুন্দর তা হুবহু সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়। কেউ আবার সাহিত্যকে নিয়ে বেশি চিন্তা ভাবনা করতে চান না। এঁদের ধারণা ‘অৎঃ ভড়ৎ অৎঃ ংধশব’।এ অবস্থায় প্রশ্ন জাগে, তবে সাহিত্য কি শুধুই শিল্পকলা-চিত্তবিনোদনের উপাদান মাত্র; ঘটমান ঘটনার বিবরণ মাত্র? তার চেয়ে অতিরিক্ত কিছু নয়? তবে আজন্ম এই যে, শিক্ষা দীক্ষা ও জ্ঞানার্জনের ধারা, সত্য সন্ধানের প্রয়াস মনুষ্য সমাজে তা এল কোথ্থেকে? যে কোন দেশের বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় যে কোন বিষয় নিয়ে বিবেচনা করে দেখুন তো সাহিত্যই সব কিছুর নির্যাস গ্রহণ করে মানুষকে সৎ শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলার দায়িত্ব বহন করে চলেছে কিনা! মানুষের জন্ম থেকে জীবনবসান পর্যন্ত সকল কর্মকান্ডই দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত। তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতম কাজেও তার দায়িত্বে ছাড় নেই। বন্য পশুদের প্রাণ আছে এবং প্রাণধারণের প্রয়োজনও আছে। কিন্তু শিক্ষা নেই; তার দায়িত্বও নেই। প্রয়োজনে রা যুথবদ্ধ হতে পারে; কিন্তু সমাজবদ্ধ কখনো নয়। আর মানুষের ক্ষেত্রে জীবন আছে অথচ দায় দায়িত্ব নেই; লক্ষ্য নেই; পূর্ণতা প্রাপ্তীর জন্য আকুলতা নেই-একথা ভাবা যায় কি? এসব এড়িয়ে যে জীবন ধারণ; যে প্রয়োজন চরিতার্থতা-সে তো বন্যতা বা যান্ত্রিকতার তুল্য। যন্ত্র বাজন্তু ভুল করে মানুষ তাকে শুধরে দেয়। মানুষ ভুল করলে কে শোধরাবে, যন্ত্র নাকি জন্তু! জীব জগতে মানুষের চেয়ে বড় বোদ্ধা ও দায়িত্ববান আর কেউ নেই। জড় জগতের যা কিছু প্রয়োজনীয় ও গ্রহনীয় হয়েছে তা মানুষেরই আবিস্কার। অতএব মানুষই মানুষকে শোধরাবে তার লব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার দ্বারা; সত্যকে সার্থকভাবে অনুধাবনের দ্বারা। আমরা আজ নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিতে পারি যে, পৃথিবীতে অগুণতি কর্মকান্ডে মানুষের ভূমিকাই মূখ্য ও মহান। তাই সর্ব যুগে লিপিবদ্ধ হয়েছে মানুষেরই জয়গাঁথা।

সেই বৈদিক যুগে কোন কোন সত্যদ্রষ্টা ৠষি মানুষকে ‘অমৃতস্য পুত্রঃ’ বলে চিরকালীন সবচেয়ে শুদ্ধ সত্য মূল্যের শিরোপাটি পরিয়ে দিয়েছেন। আদিকাল থেকে মানুষ অমৃতের স্বাদ পেতে চেয়েছে। গুহায় পাথরে পাহাড়ে চিত্র ও শিলালিপি খোদাই করে তার চিন্তা ভাবনার স্বাক্ষর রাখার প্রয়াস পেয়েছে। সে অমরত্ব বোধ অর্জন করেছিল এই ভাবনায় যে, মৃত্যুতেই সে যেন মুছে না যায়। মরণকে অতিক্রম করা মানুষের স্বভাবগত প্রবৃত্তি; এর স্বাদ বাস্তবে কোন মিষ্টতম,স্বাদুতম খাদ্য পানীয়ের মধ্যেও লভ্য নয়। অনাস্বাদিত বলেই সে অমৃত। চিরকাঙ্খিত সেই দূর্লভ বস্তুুকে পাওয়ার প্ররণাতেই মন্ত্রোচ্চারণ করেছিলেন- চরৈবেতি চরৈবেতি… সেই থেকে মানুষের এগিয়ে চলার সাধনা শুরু।

সচেতন হওয়াই মানুষের ধর্ম। প্রকৃতির সকল সত্য সৌন্দর্য্য, অনুভব আয়ত্তে আনাই তার আরাধনা। সুখ শান্তি ও প্রেমের প্রস্থাপনাই তার কর্ম। এই সমগ্রতা প্রাপ্তির জন্য চাই সহাবস্থান, সাহচার্য্য ও সাম্যবোধঃ। সেই অনুসারে, জীবনের সমগ্র ক্ষেত্রে চাই সুনির্দিস্ট পদ্ধতি প্রয়োগ ব্যবস্থা। অন্যথায় বৈষম্য মনুষ্যত্বকে খর্ব করে চলে। অমানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এই চলমান ছন্দের মাঝেই যখন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে মানুষের গতি ব্যাহত হওয়ার উপক্রম হয়েছে, তখনই কোন মহাজন এসে মানুষের আচ্ছন্ন চেতনাকে সচকিত করে দিয়েছেন, ’উত্তিষ্ঠিতঃ জাগ্রতঃ’ চলা থামেনি কখনো। অন্বেষার ক্রমাগত প্রেরণা মানুষকে সাহিত্য রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে; জগতের তাবৎ বস্তু ক্রিয়াকান্ড সাহিত্যে ক্যানভাসে আনার সম্ভাবনা উপলব্ধি করেছে। এই সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেছে মানুষের ভাষালিপির মহত্তম আবিস্কারে। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের নিরলস নিষ্ঠা ও শ্রমে গড়ে উঠেছে এক একটি লিপি, শব্দ ও বাক্য। যার সুষ্ঠু বিন্ন্যাস বন্ধনে গড়ে উঠেছে সাহিত্য। সাহিত্যের সার্থক সৃষ্টিতে মানুষের কাব্যগাঁথাই কালজয়ী মহাকাব্য হয়ে উঠেছে।

বাল্মীকির ‘রামায়ণ’,ব্যাসদেবের ‘মহাভারত’,হোমারের ‘ইলিয়ড ওডিসি’ মানুষের সাধ্য সাধনার সার্থক ফল। উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা অনায়সে লাভ করেছি। প্রাণী জগতে একমাত্র মানুষের আবির্ভাব থেকেই অগ্রগতির ইতিহাস সূচিত হয়েছে। সেই পাথরে পাথর ঠুকে আগুন আবিস্কার থেকে শুরু করে চন্দ্রে পদার্পন পর্যন্ত মানুষের অগ্রগতির ইতিহাস এবং তার তাৎপর্য বড় কম নয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে, সাহিত্যের বিকাশ ধারাটি বিশেষ গতিশীল হয়নি। তবে সাহিত্য স্রোত মানুষের জীবনে কতদূর এসে পৌঁছুল সে প্রসঙ্গটি আলোচনা করা জরুরী।

গোড়ার দিকে আমাদের দেশে সম্ভবত সমস্ত দেশেই সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য ছিল ধর্ম, দেব দেবী, দানব, অতি প্রাকৃত বিষয়বস্তু ইত্যাদি। ধর্মনেতা বা তখনকার সমাজপতির পৃষ্ঠপোষকতায় সাহিত্যের প্রথম পদচারণা ঘটেছিল। পরবর্তীতে সাহিত্যের অবদান সবচেয়ে বেশি।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!