খুলনা, বাংলাদেশ | ২৫ আশ্বিন, ১৪৩১ | ১০ অক্টোবর, ২০২৪

Breaking News

  দেশে ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ৩ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১০৩৩
  কুষ্টিয়ায় বজ্রপাতে ৪ জনের মৃত্যু
  আরও এক মামলায় খালাস পেলেন ফখরুল-রিজভী-আমির খসরু
  ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে রেণু হত্যা : একজনের মৃত্যুদণ্ড, ৪ জনের যাবজ্জীবন
লবণাক্ততা জয় করে ১৪ শ’ হেক্টর জমিতে আবাদ

পাইকগাছায় তরমুজ চাষে স্বপ্ন বুনছেন কৃষাণ-কৃষাণীরা

শেখ নাদীর শাহ্, পাইকগাছা

ক’বছর আগেও লবণের লাগামহীন আগ্রাসনে যেখানে সবুজ প্রকৃতি ফিরিয়ে আনা ছিল কৃষকের কাছে দুরাশা। আজ সেখানে মাঠ জুড়ে আবাদ হয়েছে তরমুজের। বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে যতদূর চোখ যায় যেন, সবুজের সমারোহ। কাঙ্খিত সাফল্যের আশায় কৃষকেরা দল বেঁধে ব্যস্ত সময় পার করছেন নিজ নিজ ক্ষেতে।

সুন্দরবন উপকূলীয় লোনা পানির জনপদে পোড় খাওয়া কৃষাণ-কৃষাণীর সোনালী স্বপ্ন দোল খাচ্ছে তরমুজের চারার প্রতিটি পত্র-পল্লবে। বসন্ত রোদে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তারা দিনের বেশিরভাগ সময় পার করছেন ক্ষেত পরিচর্যায়। এ যেন সোনালী আগামীর পথে ভিন্ন গতিতে এগিয়ে চলা ওদের।

উৎপাদন ও দাম ভাল পাওয়ায় খুলনার পাইকগাছায় প্রতি বছর বাড়ছে তরমুজের আবাদ। গতবারের চেয়ে এবার প্রায় ৩ শ’ হেক্টর বেশি ১৪ শ’ হেক্টর জমিতে আবাদ হচ্ছে তরমুজ। আবহাওয়ার অনুকূল পরিবেশে কৃষক ও কৃষি অধিদপ্তরের প্রত্যাশা উপজেলায় এবারও তরমুজের বাম্পার ফলনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে।

উপজেলার দেলুটি, গড়ইখালীতে বানিজ্যিক ভিত্তিতে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে পরীক্ষামূলক ও সৌখিন চাষীরা তরমুজ চাষে নতুন বিপ্লবের স্বাক্ষী হতে মাঠে নেমেছেন।

উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর জানায়, চলতি মৌসুমে আরো দু’ সপ্তাহ আগে থেকে কৃষকরা তরমুজের বীজ বপন শুরু করেছেন। আশা করা হচ্ছে, চলতি সপ্তাহেই কাঙ্খিত জমিতে আবাদ শেষ হবে। প্রথমে যারা বীজ বপন করেছিলেন, তাদের ৫/৬ পাতা বেরিয়ে গেছে। অনেকের ডগা বেরুনোর উপক্রম হয়েছে। মাত্র দু’বছরের ব্যবধানে চলতি বছর দ্বিগুন বেশি জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। দু’ বছর আগে উপজেলায় সাড়ে ৫শ’ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়, গতবার আবাদ হয় ১১ শ’ হেক্টর, আর এবার আবাদ হচ্ছে প্রায় ১৪ শ’ হেক্টর জমিতে। ধারণা করা হচ্ছে প্রতি বছর উপজেলায় আবাদ বাড়বে তরমুজের।

সূত্র জানায়, মাঠ মাতাতে ও বাজার সম্প্রসারণে এবার ব্যাপক হারে ড্রাগন, সুইট ড্রাগন, পাকিজা, বীগ ফ্যামিলি, কালো মানিকসহ বিভিন্ন প্রজাতির তরমুজ চাষ হয়েছে। আবহাওয়ার অনুকূল পরিবেশে বাম্পার ফলনের আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সুন্দরবন উপকূলবর্তী খুলনার লবণাক্ত পাইকগাছা উপজেলার বেশিরভাগ এলাকায় শুরু হয়েছিল লবণ পানির চিংড়ি চাষ। অধিকাংশ জমি ছিল এক ফসলি আমনের উপযোগি। কয়েক বছর আগেও প্রান্তর জুড়ে ছিল লবণ পানির চিংড়ির আবাদ। জনপদের মানুষের ঘুম ভাংতো লোনা পানির গন্ধ মেখে। অব্যাহত লোকসানের মুখে পর্যায়ক্রমে লবণ পানি বন্ধের পর শুরু হয়, তিল ও মুগ চাষ।

তবে উপজেলার গড়ইখালী ও দেলুটি অঞ্চলের এসব জমিতে একটি ফসলের পর বছরের বাকিটা সময় পতিত অবস্থায় অনাবাদি থাকত। গত কয়েক বছরে অতিবৃষ্টির কারণে লোকসানের মুখে কৃষি বিভাগের পরামর্শে তিল চাষ বাদ দিয়ে কৃষকেরা ঝুঁকে পড়েন তরমুজ চাষে। উৎপাদনের পাশাপাশি দামও ভাল পাওয়ায় ইতোমধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে তরমুজের আবাদ।

তবে দক্ষিণের লোনা পানিতে বদ্ধ কৃষিকে মূল স্রোতে ফেরাতে কৃষকের পাশাপাশি নিরলস পরিশ্রম করেছেন,স্থানীয় কৃষি বিভাগ। কঠোর পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শে প্রতিনিয়ত কৃষককে অনুপ্রানিত করছেন তারা।

অব্যাহত সফলতায় শুধু দেলুটি আর গড়ইখালীই নয়, রসালো তরমুজে স্বপ্ন বুনন সম্প্রসারিত হয়েছে উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে।

কৃষি অফিস জানায়, চলতি বছর উপজেলার দেলুটিতে ১ হাজার এবং গড়ইখালীতে ৪ শ’ হেক্টর। বিঘা প্রতি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা হিসেবে প্রতি হেক্টরে খরচ পড়ে ১ লাখ ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। সঠিকভাবে চাষাবাদ করলে হেক্টর প্রতি ৪০ থেকে ৪৫ মেট্রিকটন উৎপাদন হবে বলে আশা করছেন তারা। যা বিক্রি হতে পারে প্রায় ২ লাখ টাকা। সে অনুযায়ী উপজেলাব্যাপী প্রায় ২৮ কোটি টাকার তরমুজ বিক্রির আশা করছেন কৃষকরা।

দেলুটি ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা উত্তম কুমার কুন্ডু জানান, তরমুজ চাষী দেলুটি ইউনিয়নের কালিনগরে পরিতোষ, সেবনের বেড়ের হিরন্ময় ও গোপীপাগলা গ্রামের প্রহ্লাদ ছাড়াও এবার নতুন করে আবাদ করছেন, ফুলবাড়িয়ার সত্যেন্দ্র নাথ সরকার, বিগরদানার শিব প্রসাদ সরকার, গোপী পাগলার অসীম, তেলিখালীর সুফল মল্লিক, য়ৈদখালীর লোচন সরকার।

এছাড়া গড়ইখালী ইউনিয়নের আমিরপুরের মিল্টন, গৌতম সানা, বাইন বাড়িয়ার বীরেন্দ্রনাথ, গোবিন্দ, উত্তম, শান্তার শফিকুল ইসলাম, কুমখালীর দিলীপ ঢালী ও বাসুদেব কবিরাজ, হোগলার চক গ্রামের মলয়সহ অন্যান্যরা জানান, খুলনায় তরমুজ চাষের জন্য বিখ্যাত পাইকগাছায় এবার ব্যাপকহারে তরমুজের চাষ হয়েছে। এ এলাকার তরমুজ স্বাদ ও আকৃতিতে ব্যাতিক্রম হওয়ায় বাজারে এর চাহিদাও বেশী। করোনার প্রথম বছরে সরবরাহ বা বাজারজাত করতে না পারায় আশানুরুপ দাম পাননি চাষিরা। তবে দ্বিতীয় বছরে পরিস্থিতি কিছুটা ভাল হলেও এবার সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন তারা।

এসময় তারা আরও বলেন, কৃষকরা দুই থেকে দশ/বারো বিঘা পর্যন্ত জমিতে এবার তরমুজের বীজ বপন করছেন। অঞ্চল ও বপনভেদে একেক এলাকার ক্ষেতের চারা একেক রকমের। তবে আবহাওয়ার অনুকুল পরিবেশ বিদ্যমান থাকলে নির্দিষ্ট সময়েই ফুল-ফল চলে আসবে। গত বারের ন্যায় এবারও অনাবৃষ্টি ভোগালে কৃষি অধিদপ্তরের সহযোগিতা কামনা করেন তারা।

এ ব্যাপারে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা উত্তম কুমার কুন্ডু জানান, তরমুজের জীবনকাল ৯০-১২০ দিন। তবে ফল ধরা শুরু হয় ৬০ দিন পর থেকে। এই উপজেলায় ব্যাপকহারে ড্রাগন, পাকিজা, বীগ ফ্যামিলি, কালো মানিক জাতের তরমুজ চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে বেশি চাষ হয়েছে ড্রাগন ৫০%, সুইট ড্রাগন ২৫%, পাকিজা ২৩% ও অন্যান্য ২%।

কপিলমুনির কাশিমনগর এলাকার পবিত্র মন্ডল জানান, গতবার তিনি দু’বিঘা জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে তরমুজ চাষ করেছিলেন। তবে সঠিক পরিচর্যা ও সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আবাদ ভাল হয়নি তারা। তাই এবার ক্ষেই হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। কপোতাক্ষের চরভারাটি সরকারি জমিতে তরমুজের আবাদ করছেন, নাজমুল শেখ। তিনি বলেন, এক প্রকার কারো পরামর্শ ছাড়াই জলাশয়ের ধারে মাচা পদ্ধতির তরমুজের ক্ষেত করেছেন তিনি।

পাইকগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোঃ জাহাঙ্গীর আলম জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে তরমুজের বাম্পার ফলনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। কৃষক তাদের উচ্চ মূল্যের ফসল যাতে লাভজনক অবস্থায় নির্বিঘ্নে ঘরে তুলতে পরে সেজন্য কৃষি বিভাগের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলেও জানান কৃষি বিভাগের এ কর্মকর্তা।

খুলনা গেজেট/ এস আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!