আজ ২৫ মে। পার হয়ে গেল এক ভয়াবহ দুর্যোগের ১৫টি বছর। ২০০৯ সালের এ দিনে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আইলা বাংলাদেশ ও ভারতের একাংশে আঘাত হানে। বিধ্বংসী এ ঝড়ে সুন্দরবন-সংলগ্ন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়ন পুরোপুরি লন্ডভন্ড হয়ে যায়। ওই ইউনিয়নে নারী-শিশুসহ ৩৯ জনের প্রাণহানি ঘটে। শুধু শ্যামনগরেই গৃহহীন হন ২ লাখ ৪৩ হাজার ২৯৩ জন।
ক্যালেন্ডারের পাতা গুণে ঠিক ১৫ বছর আগের এই দিনে উপকূলবাসী প্রত্যক্ষ করে প্রকৃতির নির্মম দানবীয়তা। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঝড়ো বাতাসের মিলিত রূপ আইলা নাম নিয়ে দুপুর একটার দিকে আঁছড়ে পড়ে উপকূলে। মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যায়। দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা ও পদ্মপুকুর উপজেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং বঙ্গোপসাগরের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। আইলার আঘাতে সহস্রাধিক নলকূপ ও ২ হাজারেরও বেশি পুকুর জলাশয় জলমগ্ন হয়ে পড়ায় দুর্দশাগ্রস্ত লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগ কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ঘরবাড়ি, কৃষিজমিসহ মাছের ঘের তলিয়ে যায়। রাতারাতি নিঃস্ব হয়ে পড়েন হাজারো মানুষ। ঘূর্ণিঝড়ের ১৫ বছর পরও এখনো সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেননি এখানকার বাসিন্দারা। বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাট, বাড়িঘরে আইলার দগদগে ক্ষতচিহ্ন এখনও এখানে দৃশ্যমান।
ঘূর্ণিঝড় আইলার কারণে ঘরবাড়ি হারিয়ে অনেকে এখনো বেড়িবাঁধের ওপর বসবাস করছেন। তবে সেটিও ছাড়তে হচ্ছে তাদের। খাবার পানি ও কর্মসংস্থানের সংকটে অনেকে এলাকা ছেড়ে শহরে পাড়ি দিয়েছেন। কৃষক বা চিংড়ির ঘেরের মালিকদের অনেকে পেশা পরিবর্তন করেছেন। মাঝে পরিস্থিতির উন্নতি হলেও নিত্যনতুন দুর্যোগে তাঁরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছেন না।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, আইলার আগে উপকূলের খাবার পানির প্রধান উৎস ছিল পুকুর। কিন্তু আইলার পর একে একে ১৫ বছর পার হলেও আজও পুকুরের পানি খাওয়ার উপযোগী হয়নি। ওই ঝড়ের পর এলাকার গাছগাছালি শূন্য হয়ে এক প্রকার মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে গাবুরা।
গাবুরা ইউনিয়নের খলিশাবুনিয়া এলাকার আনার মোল্লা বলেন, আমার পরিবারে ৬ জন মানুষ। গরমকালে পানির চাহিদা অনেক। আমাকেই প্রতিদিন অন্তত চার কলস পানি নিয়ে আসতে হয় দুই কিলোমিটার দূর থেকে।
গাবুরার ৯নং সোরা গ্রামের জামিরুন্নেসা (৪৬) জানান, আইলায় তার ঘর-বাড়ি ফসলি জমি সব কিছুই নদীতে বিলিন হয়েছে। এরপর থেকে পার্শ্ববর্তী বাঁধের ওপর স্বামী ও দুই মেয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে আসছিলাম। স্বামী মারা গেছে পাঁচ বছর আগে। এখন ভিক্ষা করে খাই। এদিকে মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ায় মাথা গোজার শেষ ঠাঁই কুঁড়েঘরটাও ভেঙে নিতে বলেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এখন কোথায় যাব পরিবার নিয়ে কিভাবে বসবাস করব বুঝে উঠতে পারছি না।
শুধু আনার মোল্লা বা জামিরুন্নেসা নন, আইলার তান্ডবের জের বয়ে বেড়াচ্ছে শ্যামনগরের উপকূলজুড়ে বসবাস করা হাজারো পরিবারে। যদিও এরপর আম্পান, বুলবুলের মতো কয়েকটি বড় দুর্যোগের মোকাবিলা করতে হয়েছে তাঁদের।
গাবুরা ইউপির চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম বলেন, আইলার ক্ষতি এখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি। আইলার পর এলাকায় কর্মসংস্থানের সংকট প্রকট হয়েছে। অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তবে গাবুরা ইউনিয়নে বেড়িবাঁধ নির্মাণে সরকারের মেগা প্রকল্পের কাজ চলায় এখানকার মানুষের মাঝে একটু হলেও স্বস্তি ফিরেছে।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজিবুল আলম বলেন, দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরাকে মডেল ইউনিয়ন ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে নতুন প্রযুক্তিতে বাঁধ তৈরির জন্য ১ হাজার ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে কাজ চলমান।
উল্লেখ্য, আইলার সেই ক্ষত কাটিয়ে ওঠার আগেই ২০১৯ সালের ৪ মে ফণী, ওই বছরের ১০ নভেম্বর বুলবুল, ২০২০ সালের ২০ মে আম্ফান, ২০২১ সালে ২৬ মে ইয়াস, ২০২২ সালের ১২ মে আসনি, এরপর একই বছরের ২৫ অক্টোবর সিত্রাং এবং সর্বশেষ গতবছর ১৪ মে ‘মোখা’ আঘাত হানে। এতে আরো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সর্বশেষ উপকূলে ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাত হানার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
নতুন করে ঘূর্ণিঝড় রেমালের বার্তা উপকূলবাসীকে রীতিমতো দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে দুর্বল বেড়িবাঁধ নিয়ে আতঙ্কে রয়েছে উপকূলীয় জনপদে বসবাসকারী জনসাধারণ। কারণ উপকূলের বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজ চললেও বেশ কিছু স্থান এখনো মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।
খুলনা গেজেট/এএজে