বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন। তবু থেমে নেই সংগ্রাম। প্রতিদিন রাতে খুলনা শহর ঝাড়ু দেন ৫৯ বছরের আনোয়ারা বেগম। ৩৩ বছর ধরে চলছে তার জীবনযুদ্ধ। শহরকে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখতে আনোয়ারা বেগমের চেষ্টার কমতি নেই। ১৯৮৭ সালে খুলনা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে যোগ দেন। তখন তিনি মাস্টাররোলে কাজ করে ২৭০ টাকা বেতন পেতেন।
আনোয়ারা বেগম বলেন, স্বামীর সংসারে খুব অভাব ছিল। তখন সন্তানরা ছোট। ঘরে খাবার ছিল না। ক্ষুধার জ্বালায় কাজে নেমেছি। মনিরুল হুদা চেয়ারম্যান থাকাকালীন আমাকে ডেকে চাকরি দিয়েছিলেন। তখন ২৭০ টাকা বেতন পেতাম। পরে স্বামীও মারা যায়। খুব কষ্টে জীবন চলেছে। আমার দুই ছেলে-চার মেয়ে। সবার বিয়ে দিয়েছি। এখন খুব ভালো আছি।
শুধু আনোয়ারা বেগম নন, ময়লা-আবর্জনা, ঝড়-বৃষ্টি আর ধুলাবালুর মধ্যে ঝাড়ুদারের কাজ করছেন একঝাঁক সংগ্রামী নারী। পরিবেশ রক্ষায় তাদের অবদান অনেক।
খুলনা শহরের আরেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী মমতাজ বেগম ২২ বছর ধরে শহরের রাস্তায় কাজ করছেন তিনি। কথায় কথায় বললেন সংগ্রামী জীবনের গল্প। জীবনের দুঃখ-দুর্দশার বর্ণনা দিতে গিয়ে কয়েক দফায় কেঁদে ফেলেন এই নারী।
নগরীর চানমারী বাজার এলাকার বাসিন্দা মমতাজ বেগম বলেন, বিয়ের পর এক ছেলে হয়। ২০-২৫ বছর আগে আমাকে ও ছেলেকে রেখে স্বামী চলে যায়। পরে স্বামী আরেকটা বিয়ে করল। তখন আমি কোথায় যাব। ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি, রাতে এলাকার সন্ত্রাসীরা ঘরে চলে আসত। বাড়িওয়ালা যখন লাঠি দা নিয়ে আসত তখন তারা পালিয়ে যেত। এমন সময়ও গেছে। সেসময় খুব অভাব দেখা দেয় আমার। তখন বিভিন্ন স্থানে কাজের সন্ধান করি। কিন্তু কোথাও ভালো কাজ ছিল না। যে কাজ পেতাম সেখানেও মানুষের নানা কথা, দুর্ব্যবহারে টিকে থাকা দায় ছিল। এক মেসে রান্নার কাজে যোগ দিই। এ সময় সেখানে থাকা এক ব্যক্তির কথা না শোনার কারণে চুরির অপবাদ দেয়। এক মাস কাজ করে চলে আসি।
এরপর এক মাছের কোম্পানিতে কাজে যোগ দিই। একদিন রাতে ছেলেকে রেখে কাজে যাই। সেদিন রাতে ছেলেকে রেখে যেতে মন চায়নি। ছোট মানুষ, উঠে মাকে খুঁজবে, পাবে না। ছেলে কি করছে সেই চিন্তায় কান্না করতে থাকি। কিছুক্ষণ পর কোম্পানির নিরাপত্তাকর্মী জিজ্ঞেস করলেন কাঁদছো কেন? বললাম ছেলেকে রেখে এসেছি। সেতো আমাকে খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে যাবে। তিনি বললেন, সকালে পৌঁছে দেব। সকালে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিলেন তিনি। বাড়ি এসে দিখি ছেলে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। খাট ছিল না। গায়ে মশা। তখন তাকে জড়িয়ে ধরে একঘণ্টা কেঁদেছি।
দুর্দশার স্মৃতি বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন মমতাজ বেগম। তিনি বলেন, আমার কষ্ট দেখার কেউ ছিল না। মনে বেশি কষ্ট জমা হলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। এখন আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। ছেলে বড় হয়েছে। তাকে বিয়ে দিয়েছি। নাতি-নাতনি আছে। ভালো আছি সবাই।
তিনি বলেন, অনেক কষ্ট সহ্য করেছি। তৎকালীন মেয়র তৈয়েবুর রহমানের কাছে গিয়ে দুঃখ-দুর্দশার কথা বললে চাকরি দেন। তখন থেকে শহরের রাস্তায় ঝাড়ু দিচ্ছি। শহর পরিষ্কারে নারীরা ভূমিকা রাখছেন। অনেক নারী রয়েছেন; যারা দিন-রাত ঝাড়ু দিয়ে শহর পরিষ্কার রাখছেন।
শহরের রাস্তায় ঝাড়ু দিতে গিয়ে ভোগান্তির কথা তুলে ধরে মমতাজ বেগম বলেন, ঢাকার একটি বাস একদিন রাতে শহরে প্রবেশ করছিল। এ সময় বাসের জানালা থেকে কেউ একজন বমি করে পলিথিনের ব্যাগে ভরে রাস্তায় ফেলে যায়। সেটি মাথার ওপর এসে পড়ে। পরিষ্কার করতে গিয়ে নিজেই বমি করেছি।
শুধু তাই না, ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও কাজ করেছি। অনেক সময় বৃষ্টি হলে ছাউনিতে দাঁড়িয়ে থাকি। বৃষ্টি কমলে ঝাড়ু নিয়ে নেমে পড়ি। রাস্তায় জমে থাকা পলিথিন, কাগজ, ডাবের খোল, আমের আঁটি এগুলো কিন্তু পানিতে সরে না। বৃষ্টির সময় বেশি কষ্ট হয়। আনারসের মোথা, বাকল মানুষ রাস্তায় ফেলে; এগুলো আমাদের পরিষ্কার করতে কষ্ট হয়। নারী হিসেবে খুব চেষ্টা করি ভালো কাজ করার। কাজ ভালো হয়, না হয় সেটা মেয়র সাহেব এবং যারা কাজ করায় তারা বলতে পারবেন। আমাদের চেষ্টার ত্রুটি থাকে না। নগরের যদি সুনাম হয়, আমাদের সুনাম। মেয়র সাহেবের যদি সুনাম হয়; আমাদের সুনাম। আমরা চেষ্টা করি, ভালোভাবে কাজ করার।
নগরীর রেলস্টেশনের সামনে যেতেই কথা হয় আরেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী কুলসুম বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, অভাবের কারণে আট বছর ধরে ঝাড়ুদারের কাজ শুরু করি। অভাবে সংসার চলত না আমার। করোনার মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে শহর পরিষ্কারের কাজ করেছি। তারপর ডেঙ্গুর আক্রমণ শুরু হলো। তখনো কাজ করেছি। যেকোনো পরিস্থিতিতে আমাদের কাজ করতে হয়। রাস্তায় প্রচুর ময়লা থাকে, কষ্ট হয় অনেক। কুকুরের মলমূত্র, আবর্জনা, বাসা-বাড়ির ময়লা-আবর্জনা রাস্তায় ও আশপাশে ফেলে যায় সবাই। সেগুলোও আমরা পরিষ্কার করি। অনেকেই অসচেতন; সবসময় রাস্তায় ময়লা ফেলে রাখে।
খুলনা সিটি করপোরেশনের সহকারী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, খুলনা মহানগর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা সমান ভূমিকা রাখছেন। করোনা পরিস্থিতিতেও সবাই একসঙ্গে কাজ করেছি। আমাদের রোস্টার ডিউটি আছে। রাস্তা অনুযায়ী কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়। নগরী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে আমাদের টিম সুন্দরভাবে কাজ করছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় খুলনা সিটি করপোরেশন দেশসেরা হবে।
খুলনা সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সুপারভাইজার মো. হাফিজুর রহমান বলেন, খুলনা সিটি করপোরেশনে পুরুষ পরিচ্ছন্নতাকর্মীর পাশাপাশি নারী পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ভালো কাজ করছেন। শহরের ৩১ ওয়ার্ডে ৭০-৮০ জন নারী পরিচ্ছন্নতাকর্মী রয়েছেন। যারা দিন-রাতে শহরের রাস্তা ঝাড়ু দেন। তারা অনেক পরিশ্রমী এবং সুন্দরভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। শহরকে তারা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখছেন সবসময়।