খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

দীর্ঘমেয়াদি ব্যাথা নিরাময়ে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা

ড. এস এম ফরহাদ জামান

সাধারণত টিস্যু আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পর ব্যাথা কমার ক্ষেত্রে সাধারণ সময়ের চেয়ে বেশি সময় অতিক্রান্ত করলে তাকে দীর্ঘমেয়াদি ব্যাথা বলে। সাধারণত আঘাতপ্রাপ্ত টিস্যু সুস্থ হতে দুই সপ্তাহ সময় নেয়। কখনও কখনও এটি সুস্থ্ হতে কয়েক মাস সময় নিতে পারে। যদি ব্যাথা ৩-৬ মাস অবস্থান করে তবে ব্যাথা বিশেষজ্ঞগন একে দীর্ঘমেয়াদি ব্যাথা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

স্বল্প মেয়াদি তীব্র ব্যাথা এক ধরণের বিপদ সঙ্কেত, এটি শরীরের কোন সমস্যাকে নির্দেশ করে। অধিকাংশ ছোটখাটো ব্থাো অল্পতেই সেরে যায় এবং আমরা দ্রুত ভুলে যাই। যে ব্যাথাগুলো গুরুতর থাকে সেগুলো সাধারণত আমরা ভুলতে পারি না। যেমনঃ হাড় ভাঙ্গার ব্যাথা। এটি আমাদের জন্য সহায়ক ভুমিকা পালন করে। কারন ভাঙ্গা অংশ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত এটি নড়াচড়া প্রতিহত করে।

স্থির ব্যাথা শরীরের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থা সম্বন্ধে আমাদের ধারনা দেয় যেমনঃ কোমর ব্যাথা বাগিঁতে ব্যাথা। এই জাতীয় ব্যাথা আমাদের জন্য বিরক্তিকর। কখনও কখনও বিধ্বস্ত রুপে আবির্ভূত হয়। এই জাতীয় ব্যাথা সময়ের সাথে সাথে আমাদের জীবন যাপন প্রণালী, কাজ করার সামর্থ্য এবং নিদ্রা অভ্যাসকে প্রভাবিত করে।

এটি আমাদের পরিবার ও বন্ধুত্তের সম্পর্কের মাঝে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দীর্ঘমেয়াদি ব্যাথার কারণ সবসময় পরিস্কার নয়। শরীরের যে কোন অংশ, যে কোন বয়সের মানুষ (শিশুরাসহ) দীর্ঘমেয়াদি ব্যাথায় আক্রান্ত হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি ব্যাথার ক্ষেত্রে আমাদের শরীরের স্নায়ু নেটওয়ার্ক ব্রেইনের ওই অংশের সাথে সম্পৃক্ত থাকে যে অংশ আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে ব্যাথা আবেগকে প্রভাবিত করে এবং আমাদের আবেগ ব্যাথাকে প্রভাবিত করে। আমরা যখন রাগান্বিত, হতাশ ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হই, তখন আমরা সাধারণত বেশি ব্যাথা অনুভব করি। যখন আমরা মানসিকভাবে সুখি থাকি তখন আমরা কম ব্যাথা অনুভব করি  এবং পরিস্থিতি ভালভাবে সামাল দিতে পারি। বৈজ্ঞানিক গবেষণা দ্বারা প্রমানিত দীর্ঘমেয়াদি ব্যাথার ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক রোগীকে তার সমস্যা অনুযায়ী মূল্যায়ন করেন এবং সমস্যার কারন বের করেন। রোগীর চলাফেরা ও মাংসপেশির ক্রিয়াকলাপ পরীক্ষা করেন এবং একটি চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করেন। এক্ষেত্রে সুনিদৃষ্ট ম্যনুয়াল থেরাপি যেমন সফটটিস্যুরিলিজ, মবিলাইজেশন, চলাফেরার ক্ষেত্রে পরামর্শ, দেহের সঠিক ভঙ্গি অনুশীলন গুরুত্বপূর্ণ। তিনি রোগীকে সঠিক জুতা নির্বাচনের পরামর্শও দিতে পারেন। থেরাপিউটিক এক্সারসাইজ দীর্ঘমেয়াদি ব্যাথা নিরাময়ের ক্ষেত্রে সাহায্য করে। শরীরে এন্ডরফিন নামক কেমিকেল এর পরিমাণ বাড়ায়। যেটা শরীরে প্রাকৃতিক পেইন কিলার হিসেবে কাজ করে। মাংসপেশি, লিগামেন্ট ও জয়েন্ট এর মধ্যকার টান ও শক্তভাব কমায়। শারীরিক ওজন কমায়, হৃদরোগ এর ঝুঁকি কমায়, অস্টিওপরসিস, দুর্বল ভারসাম্য ও পড়ে যাওয়ার প্রবণতা কমায়। রিলাকজেসন টেকনিক অবিরাম পেইন এবং মাংসপেশিরটান কমাতে সাহায্য করে এবং ঘুমের উন্নতি ঘটায়। বিভিন্ন রকম রিলাকজেসন টেকনিক আছে, যেমন শ্বাস-প্রশ্বাস এর ব্যায়াম ও মেডিটেশন। ব্যাথা মানুষকে দুর্বল করে দেয়, মেজাজ খিটখিটে করে ও উদিগ্নতাকে বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘমেয়াদী ব্যাথা কমাতে আপনি উপভোগ করেন এমন ক্রিয়াকলাপ বেছে নিন যা আপনাকে ব্যাথা থেকে দূরে রাখবে।

গবেষণা অনুযায়ী ইংল্যান্ডে প্রতিবছর ৭.৮ মিলিয়ন মানুষ দীর্ঘমেয়াদি ব্যাথায় ভোগে এবং পেইন এ আক্রান্ত রোগীদের প্রতিবছর ৫৮৪ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় হয় ব্যবস্থাপত্রের পেছনে। দীর্ঘমেয়াদি ব্যাথায় আক্রান্ত ২৫% রোগীরা কাজ  ছাড়তে বাধ্য হয়।

গবেষণা হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা পদ্ধতিতে নিম্নলিখিতভাবে দীর্ঘমেয়াদি ব্যাথার চিকিৎসা করা হয়।

পেশেন্ট এডুকেশনঃ দীর্ঘমেয়াদি ব্যাথার বিষয়ে রোগীর বোঝার ক্ষমতা বাড়ানো এই ধরনের ব্যথা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

এক্সারসাইজ থেরাপিঃ যে সমস্ত ব্যয়াম ব্যাথা কমায় অথবা ব্যাথা মুক্ত করে এবং রোগীকে চলনসই করে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকগণ সেগুলো রোগীকে পরামর্শ দিতে পারেন। রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী শক্তি বৃদ্ধি ও ফ্লেক্সিবিলিটি বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যয়ামের পরিমাণ কম বেশি করতে পারেন।

ম্যানুয়াল থেরাপিঃ দীর্ঘমেয়াদি ব্যাথার কারনে শারীরিক নড়াচড়া ও ব্যয়ামের পরিমাণ  কমে যায়। এর ফলে জয়েন্ট এবং সফট টিস্যু যথাঃ মাংসপেশি, লিগামেন্ট, টেন্ডন, স্নায়ু শক্ত হয়ে যায় ও প্রদাহ সৃষ্টি করে।ম্যয়োফ্যাসিয়ালরিলিজ, ট্রিগার পয়েন্ট থেরাপি এবং স্ট্রেচিং নড়াচড়ার উন্নতি সাধন করে ও ব্যাথা কমায়।

দেহের সঠিক ভঙ্গি অনুশীলনঃ সঠিক ভঙ্গি অনুশীলনের মাধ্যমে জয়েন্ট এর মধ্যকার আভ্যন্তরীণ চাপ কমে। ফলে ব্যাথা কমে যায়।

কগনিটিভ বিহ্যাভিওরাল থেরাপিঃ এটি  একটি মেডিটেটিভ বারিলাকজেসন থেরাপি। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত  ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকগণ দীর্ঘমেয়াদি ব্যাথায় এটিব্যবহার করে থাকেন। এই ধরনের থেরাপি এককভাবে অথবা গ্রুপ ভিত্তিতে প্রদান করা হয়।

আকুপাংচারঃ প্রাচীনতম এই চাইনিজ মেডিসিন দীর্ঘমেয়াদি ব্যাথার বিকল্প চিকিৎসা হিসাবে ব্যবহার হয়। ইংল্যান্ড এর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ওফ হেলথ এর তথ্য  মতে দীর্ঘমেয়াদি নেক পেইন, ব্যাক পেইন, হাঁটুর অষ্টি ও আর্থাইটিস এ আকুপাংচার কার্যকর।

ইলেক্ট্রোথেরাপিঃ  ব্যাথার অনুভূতিক মিয়ে দিতে ইলেক্ট্রো থেরাপি কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

হট অ্যান্ড কোল্ড থেরাপি ট্রিটমেন্টঃ ব্যাথার অনুভূতি কমানোর ক্ষেত্রে কার্যকর। গরম মাংসপেশিকে শিথিল হতে সাহায্য করে, ব্যাথা জায়গায় রক্ত সরবরাহের  পরিমাণ বাড়ায়। যা ব্যাথাকে কমিয়ে দেয়। কোল্ড থেরাপি  ব্যাথা  জায়গায় রক্ত সরবরাহের পরিমাণ কমিয়ে দেয়, অবশ অনুভূতি প্রদান করে  এবং স্নায়ুর মাধ্যমে পেইন সিগন্যালকে মস্তিষ্কে পৌছানোর গতিকে ধীর করে।

কাপিং থেরাপিঃ যেসব টিস্যু শক্ত হয়ে ডিস্ফাংশন তৈরি করে সেগুলোকে স্বাভাবিক করতে এবং টিস্যুর মধ্যকার ইম্পিউরিটিস দূর করতে  ব্যবহার হয়।

দীর্ঘমেয়াদী ব্যাথায় যেসব রোগী ভোগেন তারা এই সমন্বিত চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করে ব্যাথাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন ও ব্যাথামুক্ত থাকতে পারেন এবং প্রাতিদিনের জীবন যাত্রায় স্বাভাবিক অংশগ্রহণের  প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার লক্ষ্য হল রোগীকে তার জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষমতা প্রদান করা এবং দীর্ঘমেয়াদি ব্যাথা সংক্রান্ত ভীতি কমিয়ে রোগীকে আশ্বস্ত করা।

লেখকঃ মাস্কুলোস্কেলেটাল (ম্যাকানিক্যাল) পেইন স্পেশালিষ্ট।
প্রিন্সিপাল (ভারপ্রাপ্ত) ও সহকারীঅধ্যাপক (ফিজিওথেরাপি), জিরো পেইন ইন্সটিটিউট অব হেলথ সায়েন্স,
সোনাডাঙ্গা আ/এ (১ম ফেজ),খুলনা।

খুলনা গেজেট/ টি আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!