সামনে পরীক্ষা, আপনি উদ্বিগ্ন এবং ভয় পাচ্ছে; এমনটি হতেই পারে- আর এই ভয় এক সময়ে দুশ্চিন্তায় পরিণত হতে পারে। আবার মনে করেন আর দুই দিন পরে সন্তানের পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে,আপনি বেশ কয়েক দিন যাবৎ উদ্বিগ্ন; হতেই পারে আর এমনটি প্রায় মানুষেরই ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। মানুষের জীবনে কোন বিষয়ে ভয় থেকে উদ্বিগ্নতা সৃষ্টি হয় আর উদ্বিগ্নতা থেকে সৃষ্টি হয় দুশ্চিন্তা। মানুষের জীবনে কিছুটা উদ্বিগ্নতা জীবন সুন্দরভাবে গঠনে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু উদ্বিগ্নতা যখন তার স্বাভাবিকতার মাত্রাকে পরাভূত করে, তখন তাহা মানুষের জীবনে ক্ষতিকর হিসেবে প্রতিভাত হয় যা উদ্বিগ্নজনিত বিকৃতি হিসেবে বিবেচিত।
উদ্বিগ্নতা কখন দেখা যায়: ব্যক্তির মধ্যে সাধারণত: বয়সন্ধিকালের শেষ প্রান্তে এটা দেখা দেয়। তবে কোন পীড়নমূলক ঘটনার পরে মানুষের মধ্যে ও উদ্বিগ্নতার প্রাদূর্ভাব ঘটতে পারে এবং পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে এ রোগের প্রবনতা তুলনামূলক ভাবে বেশি দেখা যায়।
উদ্বিগ্নতার মানসিক লক্ষণ সমূহ: উদ্বিগ্নতা যখন মানসিক বিকৃতিতে পরিণত হয়, তখন বেশ কিছু মানসিক লক্ষণ দেখা দেয়। লক্ষণ সমূহ হলো (১) কোন তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে পূন:পূন: উদ্বিগ্নতা বোধ করা। (২) যে কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে দুশ্চিন্তা অনুভব করা এবং ব্যক্তি ইচ্ছা করলে ও তা দূর করতে পারে না। (৩) ব্যক্তি কোন কিছুতে সহজে চমকে উঠে। (৪) ব্যক্তির মধ্যে চলা ফেরায় অস্থিরতা দেখা দেয় এবং প্রায় ছট ফট করে। (৫) ব্যক্তির মধ্যে নিত্য দিনের কাজ কর্মে অস্থিরতা দেখা দেয় (৬) কেউ কেউ মনে করে সহসা তার মৃত্যু ঘটতে পারে (৭) ব্যক্তির সহজে মনোযোগ বিচ্যুতি ঘটে। (৮) ব্যক্তি বিভিন্ন কাজে প্রায় সময় উৎকন্ঠিত ও অতিসতর্ক থাকে। (৮) ব্যক্তি প্রায় সময় ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত থাকে। (৯) ব্যক্তি মনে করে ,সহসা সে কোন দূর্ঘটনায় পতিত হতে যাচ্ছে এবং শিঘ্র সে তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে।
উদ্বিগ্নতার শারীরিক লক্ষণসমূহ: উদ্বিগ্নতার কিছু শারীরিক লক্ষণ বিদ্যমান- (১) হৃদ স্পন্দন বেশি দেখা দেয়, ঘাম হয়। (২) পাকস্থলির গোলযোগ দেখা দেয়, ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা দেখা দেয়। (৩) ব্যক্তির মধ্যে ঘন ঘন প্রস্থাব প্রবনতা দেখা দেয়। (৪) হাত পা ঠান্ডা অনুভব হতে থাকে।(৫) ব্যক্তির নাড়ী এবং শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যেতে পারে। (৬) অনেক সময় পেশীর টান টান এবং ব্যথা অনুভব হতে পারে। (৭) ব্যক্তির মধ্যে সহজে ক্লান্ত হওয়ার প্রবনতা দেখা দেয়।(৮) ব্যক্তির মধ্যে নিজের শারীরিক নিয়ন্ত্রণ করার অক্ষমতা দেখা দেয়।
উদ্বিগ্নতার কারণ সমূহ : উদ্বিগ্নতার কারণকে কতিপয় মতবাদের সাহায্যে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো- (১) মনোসমীক্ষণ মতবাদ: এ মতবাদ অনুসারে ব্যক্তির আদি কামনা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আক্রমনাত্মক এবং সর্বদা বহি:প্রকাশের পথ খুঁজে কিন্তু অহং সত্তা আদি কামনার এ আক্রমনাত্মক ধারণাকে গুলোকে বাইরে আসতে বাধা দেয়। অর্থাৎ আদিম কামনা ও অহং সত্তার দ্বন্দ্বের কারণে ব্যক্তির মধ্যে অনেক সময় উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। (২) জ্ঞানীয় আচরণবাদীদের ধারণা: এ ধারণা মতে ব্যক্তি যখন কোন পরিস্থিতির সম্মূখীন হয়, যার উপর তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নাই- এই প্রত্যক্ষণমূলক ঘটনাটির উপর ব্যক্তি তখন আরো বেশি জোর দেয় এবং ব্যক্তি অনুভব করে ঘটনাটির উপর তার কোন নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নাই; অর্থাৎ ব্যক্তি অক্ষম এবং অসহায়।এরুপ অসহায়ত্ব ধারণা ব্যক্তিকে উদ্বেগে বর্শীভ’ত করে। (৩) ঘটনার পূর্বানুমান সাপেক্ষতা: ব্যক্তির নিকট বিপদজনক ঘটনাটি যদি পূর্বানুমান সাপেক্ষ হয় তবে উদ্বেগ কম হয় আর যদি ঘটনাটি পূর্বানুমান সাপেক্ষ না হয় তবে উদ্বেগ বেশি হয়। (৪) ঘটনার অপব্যাখ্যা : যে সব ব্যক্তি কোন সাধারণ ঘটনাকে বেশী বিপদজনক ভাবে মূল্যায়ণ করে, তারা সাধারণত: অন্যান্যদের তুলনায় উদ্বেগে বেশি আক্রান্ত হয়। (৫) মনোযোগের কেন্দ্রীকতা: কিছু ব্যক্তি আছে -তারা সাধারণত: বিপদজনক ঘটনার প্রতি মনোযোগকে বেশি নিবদ্ধ করে, আর এ কারণে তারা প্রায়শ: তুলনা মূলক ভাবে দুশ্চিন্তায় বেশি ভোগে থাকে। (৬) জৈবিক দৃষ্টিভঙ্গি:নিউরো ট্্রানেন্স মিটার জিএবিএ প্রনালীর ত্রুটির জন্য ও ব্যক্তির ভিতর উদ্বেগ বৃদ্ধি পায়। আবার বংশগত কারণে ও উদ্বেগ বৃদ্ধি পাওয়া প্রমান পাওয়া যায়।
উদ্বিগ্নতা তথা দুশ্চিন্তা দূর করার উপায় সমূহ: (১) জৈবিক চিকিৎসা পদ্ধতি: উদ্বেগ জনীত বিকৃতির সাথে বিষন্নতা ও দুশ্চিন্তা ওতোপ্রোত ভাবে জড়ীত। তাই উদ্বিগ্নতা চিকিৎসার জন্য জৈবিক ঔষধ বঞ্জোডায়াজেপাইন জাতীয ঔষধের মধ্যে এলপ্রাজোলাম, ডায়াজিপাম, ক্লোনাজিপাম গ্রুপের ঔষধ সেবনে ভাল ফল পাওয়া যায়। তবে এসব ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি এবং আসক্তি সৃষ্টিকারী ক্ষমতা আছে তাই এ গুলো সেবন না করাই ভাল। (২) ব্যামাভ্যাস: নিয়মিত সময় করে ব্যাম করলে শরীর এন্ডোরফিন নামক ক্যামিক্যাল নি:সরণ ঘটে যা ব্যক্তিকে দুশ্চিন্তা মুক্ত রাখতে সহায়তা করে। (৩) ব্যক্তির সামাজিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করা – ব্যক্তির যাতে সক্ষমতা বোধ অক্ষুন্ন থাকে এমন সব কৌশলের মধ্যে আছে-(ক) আত্ম- প্রতিষ্ঠামূলক প্রশিক্ষণ (খ) ভাষাগত ও মৌখিক নির্দেশনা (গ) করণ শিক্ষণের মাধ্যমে আচরণ শিক্ষণ (ঘ) রিহার্সেলের মাধ্যমে ব্যক্তির সামনে তার করণীয় ফুটিয়ে তোলা, ইত্যাদির পদ্ধতি সমূহ ব্যক্তির জন্য ব্যবস্থা করা। (৪) শ্লথন অভ্যাস করানো : উদ্বেগজনীত রোগীদের তাদের শারীরিক উত্তেজনা সম্পর্কে ভীতগ্রস্ত হতে দেখা যায়, সেজন্য তাদের শ্লথন অভ্যাস করালে ভাল ফল পাওয়া যায়। (৫) জ্ঞানীয় সংগঠন পরিস্থিতির পূর্ণমূল্যায়ন: উদ্বেগজনীত ব্যক্তি প্রায় ক্ষেত্রে ঋনাত্মক ঘটনা ঘটার সম্ভবনা বাড়িয়ে দেখে। সে জন্য জ্ঞানীয় সংগঠন পদ্ধতিতে উদ্বেগজনীত ব্যক্তিকে এসব পরিস্থিতিকে পূনর্মূল্যায়ন করতে সাহায্য করা হয়। এতে তার উদ্বেগের মাত্রা ক্রমে হ্রাস পায়। (৬) সমাধানমূলক আচরণের শিক্ষা : এ পদ্ধতিতে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ব্যক্তিকে সমস্যা সমাধানমূলক আচরণের শিক্ষা দেওয়া হয় এবং তার ফলে ক্রমে ব্যক্তির দুশ্চিন্তা হ্রাস পায় । (৭) রিল্যাক্সসেসন থ্যারাপি: এ পদ্ধতিতে ব্যক্তিকে তার দেহ-মন রিল্যাক্স করতে শেখানো হয়। এতে ব্যক্তির দেহ মন চিন্তা গ্রহণ থেকে বিরত থাকে।
বর্তমান সামাজিক বাস্তবতায় মানুষ আজ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। দিন দিন মানুষের চাহিদা ও প্রাপ্তির মাঝে অসামঞ্জস্যতা গ্রাস করতে বসেছে। এমনি একটি বাস্তবতায় মানুষের মধ্যে উদ্বিগ্নতা থেকে দুশ্চিন্তা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে যা ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবন যাত্রাকে ব্যহত করছে। তাই এরুপ পরিস্থিতিতে একজন মনোবিজ্ঞানীর শরণাপন্ন হয়ে এ সমস্যা হতে পরিত্রান পাওয়া একেবারেই সম্ভব।
(লেখক; সহকারি অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজ, খুলনা। ফ্রি পরামর্শ: ০১৭১৪৬১৬০০১ )
খুলনা গেজেট/এ হোসেন