৮ বছর বয়সে মাকে হারান। পিতা অন্যত্র বিয়ে করার পরে এক পর্যায়ে খুলনা শহরে একটি আবাসিক বাসাবাড়িতে পেটে ভাতে কাজ শুরু করেন। ১৬ বছর বয়সে বাড়ির মালিকের সহায়তায় তার বিয়ে হয়। গর্ভে সন্তান আসার পরে স্বামী মারা যায়। ঘর আলোকিত করে কোলজুড়ে আসে একটা কন্যা সন্তান। মেয়ের বয়স ২ বছর হলে বশির সরদার নামের একজনের সাথে পুনরায় বিয়ে করেন। নতুন স্বপ্ন নিয়ে স্বামীর বাড়িতে ফের সংসার জীবন শুরু করেন। সেখানের একটি পুকুর থেকে পানি নিয়ে কলসি প্রতি এক টাকা দরে মাছের ডিপোসহ বিভিন্ন দোকানে দিতেন। দারিদ্র স্বামী ও তার আয়ে মোটামুটি ভালই চলছিল তাদের সংসার। এক পর্যায়ে স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়ায় ভারী কাজ করার সক্ষমতা হারান। সংসারে অভাব অনটন বৃদ্ধি পেতে থাকে। এখন তার কোমরে আর জোর নেই। ভ্যানে করে একই এলাকায় পানি বিতরণ করছেন এখনও। তবে পুকুরের পানি নয়, কাক ডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আধা কিলোমিটার দূরের একটি সাপ্লাই পানির কারখানা থেকে কিনে দোকানে দিচ্ছেন তিনি। ২২ বছরে কলস প্রতি ২ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে এখন পাচ্ছেন ৩ টাকা। এতে তার প্রতিদিন ১২০ থেকে ১৫০ টাকা আয় হচ্ছে। পাশাপাশি একটি ফাস্টফুডের দোকানের পেঁয়াজ কুচিয়ে দিয়ে মাসে এক হাজার একশ’ টাকা বেতন পান। এভাবেই চলছে বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার ঝালোডাঙ্গা গ্রামের নূরু মোহাম্মাদ গাজী সংগ্রামী নারী নূপুর খাতুনের (৪৩) সংসার। তিনি বর্তমানে স্বামীর সাথে খুলনার কয়রা উপজেলার আমাদী গ্রামে বসবাস করছেন।
সরেজমিন আমাদী বাজারে ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে এ প্রতিবেদকের সামনে পড়লে দুঃখভরাক্রান্ত মনে এসব কথা জানান কয়রা উপজেলার আমাদী গ্রামের বশির সরদারের স্ত্রী জীবন সংগ্রামে পরাজিত নারী নূপুর খাতুন।
তিনি আরও বলেন, প্রায় ২২ বছর যাবত কলস নিয়ে পানি বয়ে আমাদী বাজারের বিভিন্ন হোটেল, রেস্তোরাঁয়, চায়ের দোকানে পানি বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছি। এতদিন কোমরে করে পানি বয়েছি। এখন আর পারি না। মসজিদকুঁড় ব্রীজ সংলগ্ন একটি সাপ্লাই পানির কারখানা থেকে ৩/৪ বছর যাবত ভ্যানে করে পানি সরবরাহ করি। রোদ্র বৃষ্টি ঝড় আমার মাথার উপর দিয়ে যায়। একথা বলে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি তিনি।
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, হাত পা আছে তাই খেটে খাচ্ছি, তেমন কোন সাহায্য পাইনি। দিনে কলসে করে পানি বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়ে কোন রকমে দু’মুঠো ভাত খাচ্ছি। কতো কষ্ট করে জীবন যাপন করি তা কাউকে বলে বুঝতে পারবো না।মাঝে মধ্যে না খেয়েও থাকতে হয়। এতিম মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলাম। তার কপালেও সুখ জুটলো না। তিন বছরের একটি ছেলেসহ তাকে ফেলে রেখে জামাই চলে গেছে।
তিনি আরও বলেন, ভোর রাতে যেয়ে একটি দোকানে প্রতিদিন ১০/১২ কেজি পেঁয়াজ কেটে দেই। সেখান থেকে মাসে এক হাজার একশ’ টাকা আয় হয়। এছাড়া স্বামী গ্রামে গ্রামে ফেরি করে হলুদ বিক্রি করে কিছু আয় করেন। আমাদের আয়ে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির মধ্যে সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। নদীর চরে একটি গোলপাতার ছাউনির ঘর রয়েছে। সেখানে কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে বসবাস করছি।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. জিয়াউর রহমান জুয়েল বলেন, নূপুর খুবই অসহায়। দীর্ঘদিন আমাদী বাজারের বিভিন্ন দোকানে পানি সরবরাহ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বিগতদিনে তিনি সরকারী কোন সহযোগীতা পেয়েছেন কিনা জানিনা। এবছর ভিডব্লিউবি কর্মসূচিতে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। এখনো চূড়ান্ত তালিকা তৈরি হয়নি। এছাড়া অনুদান আসলে তাকে সহযোগীতা করার আশ্বাস দেন তিনি।
কয়রা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রেশমা আক্তার বলেন, নূপুরের মানবেতর জীবনযাপনের বিষয়টি আমার জানা ছিল না। ভিডব্লিউবি কর্মসূচিতে অন্তর্ভূক্ত করা হবে। এছাড়া পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে সর্বাত্নক সহায়তার কথা জানান তিনি।