খুলনা, বাংলাদেশ | ৬ মাঘ, ১৪৩১ | ২০ জানুয়ারি, ২০২৫

Breaking News

  দৈনিক ভোরের কাগজের প্রধান কার্যালয় বন্ধ ঘোষণা
  সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমার ক্ষমতা চ্যালেঞ্জ করে রিট দায়ের

খুলনায় তৈরি হচ্ছে চুইঝালের পাউডার, রপ্তানি হবে থাইল্যান্ড

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রাকৃতিক ভেষজগুণ সম্পন্ন উদ্ভিদ চুইঝাল কদর দিন দিন বেড়ে চলেছে। সারাদেশে খুলনার চুই ঝালের চারার কদর রয়েছে। মাটিতে কিংবা অন্য গাছের আশ্রয়ে লতার মতো বেড়ে ওঠে চুই ঝাল গাছ। চুই ঝালের পাতা, কাণ্ড, শেকড়, ফুল, ফল, ডাল সবই ঔষধি গুণসম্পন্ন। স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় এই মসলা গরু, খাসি, মুরগি ও হাঁসের মাংসের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির মাছের তারকারীতেও ব্যবহার করা হয়। কান্ড, বাকল, শেকড় তরকারীতে ব্যবহার করা হলেও এবার চুই ঝালের মসলার স্থায়িত্ব বাড়াতে যুক্ত হয়েছে নতুনত্ব। ক্রেতাদের সুবিধার জন্য চুই ঝালের পাউডার (গুড়া) মশলা তৈরি করে নতুন রূপ দিয়েছেন খুলনার কৃষক নবদ্বীপ মল্লিক ও নিউটন মন্ডল।

বর্তমানে চুইগুড়ার ব্যবহারও শুরু হয়েছে। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে অত্যন্ত সহজ পদ্ধতিতে শেকড়, বাকল, ডাল রোদে শুকিয়ে বিলিন্ডার বা মেশিনে গুড়া করে চুইয়ের গুড়া মশলা তৈরি করছেন তারা। আর এই গুড়া মশলা শুধু দেশীয় বাজারেই নয়, যাবে বিদেশেও। প্রথমবারের মতো চুই ঝালের গুড়া মশলা পাঠানো হচ্ছে থাইল্যান্ডে।

কৃষক নবদ্বীপ মল্লিক বলেন, ২০১৭ সালে কৃষি অফিসের সহায়তায় চুই ঝালকে বাণিজ্যিক রূপ দিতে কাজ শুরু করি। ২০১৮ সাল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে চুইয়ের চারা বিক্রি শুরু করি আমি ও নিউটন। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি আমাদের। নিজেদের উৎপাদিত চুই ঝালের পাশাপাশি অন্য কৃষকদের কাছ থেকে এই চুই ঝালের শেকড়, কান্ড, লতা কিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করছি। তবে চুই লতা কাটার পর এর শেকড়, বাকল, ডাল বেশিদিন রাখা সম্ভব হয় না। শুকিয়ে কাঠে পরিণত হলে সেটি আর মসলা হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। আবার চুই এর কাচা ডাল, শেকড় ও লতা কুরিয়ার করে পাঠাতে অনেক সময় ২/৩ দিন লেগে যায়। এতে চুই ঝাল নষ্ট হয়ে যায়।

তিনি বলেন, চুই ঝাল নষ্ট হওয়া বন্ধ করতে ও নতুন রুপ দিতে কৃষি কর্মকর্তা মোসাদ্দেক হোসেনের পরামর্শে চুই ঝালের পাউডার তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। সেই অনুযায়ী গুড়া মশলা তৈরি করে খেয়েছি, যা খুবই সুস্বাদু। তবে চুই ঝাল চিবিয়ে খেয়ে যেই স্বাদ পাওয়া যায়, সেটি গুড়া মসলায় পাওয়া যাবে না। কিন্তু গুড়া মসলায় দারুণ একটা স্বাদ রয়েছে। এখন এই চুইয়ের পাউডার সাতক্ষীরার সাঈদ ভাইয়ের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো থাইল্যান্ড পাঠানো হবে। দেশের পাশাপাশি বিদেশের বাজার ধরতে পারলে চুই ঝালের কদর বহুগুণে বেড়ে যাবে।

নবদ্বীপ মল্লিকের পিতা সুভাষ মল্লিক বলেন, দেড় বছর থেকে ৫ বছর বয়সী চুইঝাল খেতে সুস্বাদু। চুই ঝাল গাছ দুই রকমের হয়। একটি ঝুটো চুই (মাটিতে হয়) আরেকটি গাছ চুই (অন্য গাছের সাথে লতার মতো উঠে যায়)। দুই চুই ঝালের দুই রকম স্বাদ। তবে ঝুটো চুইঝালে স্বাদ বেশি। তিনি বলেন, চুই ঝালের পাউডার তৈরির জন্য চুই গাছ কেটে এনে সেটিকে জল দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হয়। একটি কাঠের কান্ডে রেখে চুইজাল ছোট ছোট টুকরো করে কাটতে হয়। কাটার পর রোদে শুকাতে হয়। রোদে শুকানোর পর কম হলে বাড়িতে বিলিন্ডারে আর বেশি হলে মিলে নিয়ে মেশিনে গুঁড়ো করা হয়।  তারপর গুঁড়া মসলা প্যাকেট করে বাইরে বিক্রি করা হয়।

কৃষক নবদ্বীপ মল্লিকের স্ত্রী মুক্তা মল্লিক বলেন, মূলত চুইঝালের মসলা মুড়িঘন্ট, মাংসে ব্যবহার করা হয়। খিচুড়িতে ও মুড়িমাখাতে ব্যাবহার করা যায়।  চুইঝালের আসলে অনেকগুলো ব্যবহার রয়েছে। এছাড়া চুই ঝালের গুঁড়োও অনেকভাবে ব্যবহার করা যায়। প্রত্যেক তরিতরকারিতে দেওয়া যায় মসলা হিসেবে। চুই ঝালের কান্ড ও গুঁড়া মসলা দুটো দুই রকমের। তবে চুইঝালটা যেটা চিবিয়ে খায় তার স্বাদ এক রকম আর গুড়া মসলার স্বাদ অন্যরকম। কিন্ত দুটোই খুব মজাদার।  আমরা গত বছর চুই ঝালের গুড়া করেছি। সেই গুঁড়ামসলা বিভিন্ন তরকারিতে দিয়েছি। যেমন গোলমরিচের গুড়ো দেওয়া হয় সেই ভাবেই দিয়ে মসলা হিসেবে খেয়েছি, খুবই মজাদার।

কৃষক নিউটন মন্ডল বলেন, চুই গাছের শেকড়, ডাল বিক্রি করে অনেক সময় উপযুক্ত দাম পায় না কৃষকরা। আমরা সেই বিষয়টি বিবেচনা করে কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে চুই ঝালের পাউডার তৈরির কাজ শুরু করি। প্রথমবার পাউডার তৈরি করে খেয়েছি এবং অন্যদেরকে দিয়েছি, খুবই ভালো সুস্বাদু। এবার আমরা এক কেজি চুই ঝালের গুঁড়ামসলা থাইল্যন্ডে পাঠাচ্ছি। থাইল্যান্ড পাঠানোর পরে সাড়া মিললে যারা আমাদের কাছ থেকে চারা নেয় তাদের উৎপাদিত চুই কিনে নিয়ে পাউডার করবো। বাংলাদেশের পাশাপাশি বিদেশি চুই রপ্তানি করব। তিনি বলেন, ১২ কেজি চুইয়ের শেকড়, ডাল শুকিয়ে এক কেজি পাউডার তৈরি হয়। ফলে এর দাম অনেক বেশি পড়ে যায়। আমরা পাউডারের মান ও প্রকারভেদে দাম নির্ধারণ করেছি। কেজিপ্রতি ৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত মানভেদে চুই ঝালের পাউডার বিক্রি করা হবে।

ডুমুরিয়া উপজেলা সিনিয়র কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, চুই একটি উচ্চমূল্যের ফসল এবং ঔষধি গুণসম্পন্ন। চুই খেলে অনেক রোগের উপকার হয়। বিশেষ করে যারা বৃদ্ধ মানুষ, যাদের গিঁটে গিঁটে ব্যথা হয়; তারা যদি নিয়মিত চুই খায় তাহলে এই ব্যথা নিরাময় হয়। চুই ঝাল বিক্রি করতে কোন সমস্যা হয় না। দীর্ঘদিন ধরে খুলনা এলাকাতে বিক্ষিপ্তভাবে চুই ঝালের চাষ হয়। লোকজন বাগান বাদারে দু-একটি চুই ঝালের চাষ করতো। কিন্তু আমাদের সহযোগিতায় দুইজন কৃষক নবদ্বীপ মল্লিক ও নিউটন মন্ডল সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকীকরণের জন্য আমাদের একটি প্রকল্পের সহযোগিতা পেয়ে প্রথমে প্রদর্শনী আকারে মাতৃগাছ তৈরি করে। তারপর থেকে চারা গাছ তৈরি করে বিক্রি করেছেন। এ বছর পর্যন্ত তারা জন ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার চারা বিক্রি করেছেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও চাহিদা রয়েছে চুই ঝালের। চুই ঝালের কান্ড, শেকড় পাঠলে অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। ফলে তারা চুইয়ের যে প্রকৃত স্বাদ সেটি গ্রহণ করতে পারে না। এজন্য আমাদের নবদ্বীপ মল্লিক এবং নিউটন মন্ডল স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্লেন্ডিংয়ের মাধ্যমে চুই ঝালের গুঁড়ো তৈরি করে এর পাউডারটি বিদেশে পাঠাচ্ছে। প্রথম চালান তারা থাইল্যান্ডের পাঠাচ্ছে।

তিনি বলেন, চুইঝাল যাতে অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে যায়, সেজন্য আমাদের একটি প্রকল্প রয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় গোপালগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাট ও  পিরোজপুর। এই প্রকল্পের আওতায় প্রত্যেকটা উপজেলায় ৪/৫ টি চুইগ্রাম হবে। এই গ্রামের প্রতিটি সদস্যের বাড়িতে অন্তত দুইটি করে চুইঝাল গাছ লাগানো হবে।

খুলনা গেজেট /এমএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!