আজ ৯ ডিসেম্বর। দক্ষিণ খুলনার ঐতিহাসিক কপিলমুনি হানাদার মুক্ত দিবস। রাজাকারদের সাথে টানা ৪ দিনের বিরতিহীন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর আজকের দিনে রাজাকারদের আত্নসমর্পণ ও জনতার রায়ে কপিলমুনি সহচরী বিদ্যা মন্দিরের মাঠে ১৫৫ জন মতান্তরে ১৫১ জন যুদ্ধাপরাধীকে গুলি করে হত্যার মধ্যদিয়ে পতন ঘটে দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ রাজাকার ঘাঁটির।
মুক্তিযুদ্ধকালীণ সময়ে (বর্তমানে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলা) ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ঘটে। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যানুযায়ী, খুলনার চুকনগরে অল্প সময়ে অধিক মানুষকে হত্যার ঘটনা ঘটে। এরপর খুলনার কপিলমুনিতে রাজাকারদের ঘাঁটি স্থাপন করে দীর্ঘদিন ধরে চলে নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ। সর্বশেষ যুদ্ধাপরাধীদেও আতœসমর্পন ও জনরায়ে দন্ড কার্যকরের ব্যতিক্রমী সর্ববৃহৎ ঘটনাটিও ঘটে কপিলমুনিতেই। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর সম্ভবত বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীণ যুদ্ধাপরাধীদের তাৎক্ষণিক বৃহৎ সংখ্যক মানুষকে সাজা দেওয়ার ঘটনা এটিই একক উদাহরণ।
৭১-এ কপিলমুনিজুড়ে রাজাকার রাজ্য :
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রাজাকাররা খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনিতে রায়সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর সুরম্য বাড়িটিকে দখল করে সেখানে শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করে। খুলনাঞ্চলে এটিই ছিল রাজাকারদের সর্ববৃহৎ ও শক্তিশালী ঘাঁটি। কয়েক শ’ রাজাকার এ-ঘাঁটি থেকেই আশপাশের অঞ্চলে ব্যাপক তান্ডব চালিয়েছিল। যুদ্ধ চলাকালীন ঘাঁটিটি দখলে মুক্তিযোদ্ধারা একাধিকবার অভিযান চালিয়েও ঘাঁটিটি অবস্থানগত সুবিধা, অস্ত্র সম্ভার, রাজাকারদের সংখ্যাধিক্য সংখ্যা ও সর্বোপরি এলাকাবাসীর অসহযোগিতায় প্রথম দিকের অভিযানগুলো সফল হয়নি। তবে প্রতিবারের অভিযানের পর রাজাকাররা আশপাশের মানুষদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিত। আর এতে করে সম্ভাব্য নির্যাতন এড়াতে সাধারণ এলাকাবাসীও মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতায় এগিয়ে আসতোনা। বিশেষ করে এ অঞ্চলে হিন্দু অধ্যুষিত হওয়ায় তাদের উপর রাজাকারদের অত্যাচার-নির্যাতনও সীমাহীন পর্যায়ে পৌছায়। হিন্দু ধর্মাবলম্বী, মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সমর্থকদের ওপর তারা অবর্ণনীয় নির্যাতন শুরু করে। কপিলমুনি ঘাঁটিকে কেন্দ্র করে আশপাশের বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে চলত নির্মম নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ। গ্রামে গ্রামে হানা দিয়ে লুটপাট, ধর্ষণ, অপহরণ ছিল রাজাকারদের নিত্যকর্ম।
প্রথমেই দখল হয়ে যায় প্রভাবশালী হিন্দু পরিবারগুলোর সমুদয় সম্পদ। তবে প্রভাবশালী হিন্দু পরিবারগুলোর কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় তাদের অনেককে বাঁচিয়ে রাখা হলেও অস্ত্রের মুখে অধিকাংশদের ধর্মান্তরে বাধ্য করা হয়। মনি সিংহ, জ্ঞান সিংহ, নরেন সিংহ, কানু পোদ্দার, তারাপদ ডাক্তার, জিতেন্দ্রনাথ সিংহ, শান্তিরাম সিংহসহ অনেক পরিবারসমূহ ধর্মান্তরে বাধ্য হয়। সেসময় তাদের অনেককে নিয়মিত নামাজ আদায় ও মসজিদে নিয়মিত হতে বাধ্য করা হয় বলেও প্রচার রয়েছে।
জানাযায়, ঘাঁটিতে নিয়মিত ২ শ’রও বেশি রাজাকার সার্বক্ষণিক সশস্ত্র অবস্থান নিয়ে সকল অপকর্ম সংঘটিত করতো। বাড়ির দখল নিয়ে তারা বেদ মন্দির থেকে বিনোদগঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা রায় সাহেবের শ্বেতপাথরের ম‚র্তিটি অপসারণ করে পুকুরের ফেলে দেয়। তাদের তান্ডবের খবরে মুক্তিযোদ্ধারা এ ঘাঁটিটি দখলের উদ্যোগ নেন। চুড়ান্ত বিজয় ডিসেম্বরের আগে ঘাঁটি পতনে অন্তত দু’বার আক্রমণের পরও ব্যর্থ হয় মুক্তিযোদ্ধারা।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ১১ জুলাই লেফটেন্যান্ট আরেফিন এর নের্তৃত্বে যুদ্ধে মুখ্য ভ‚মিকায় ছিলেন, লতিফ, সরদার ফারুক আহমেদ, মনোরঞ্জন, রহমত আলী, মাহাতাপ, দীদার, আবদুর রহিম, আনোয়ারুজ্জামান বাবলু, জাহান আলীসহ অন্যান্যরা। তাঁরা গভীর রাতে তালা উপজেলার জালালপুর থেকে বেরিয়ে রাতের শেষভাগে কপিলমুনিতে পৌছান। সেদিন বাজারের দক্ষিণ দিক থেকে তারা ঘাঁটি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করলেও কপিলমুনিতে পৌছাতে দেরি হওয়ায় আক্রমণ শুরুর কিছুক্ষণ পরই ভোর ও ক্রমান্বয়ে দিনের আলোয় অল্প সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধারা এত বড় সশস্ত্র রাজাকার ঘাঁটি দখল অসম্ভব বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন।
এরপর রাজাকাররা শক্তি বৃদ্ধি করে পাল্টা জালালপুরে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ করে। এতে মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্ন ও অনেকাংশে নিরস্ত্র হয়ে পড়েন। বাধ্য হয়ে পিছু হটেন তারা। যুদ্ধ চলাকালীন তালায় নকশালপন্থীদের তৎপরতা ছিল। প্রচার রয়েছে, তারাও একবার কপিলমুনির ঘাঁটি আক্রমণ করে ব্যর্থ হয়।
সর্বশেষ মুক্তিযোদ্ধারা সর্বোচ্চ সতর্কতায় পরিকল্পিতভাবে রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ করে। সময় নিয়ে রীতিমত ছক অনুযায়ী এগুতে থাকেন তারা। যুদ্ধ পরিকল্পনার প্রারম্ভে ছিলেন, মুজিব বাহিনীর এলাকা প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকু। কমান্ডারের জরুরী তলবে ভারতে অবস্থান করায় যুদ্ধের শুরুতে কপিলমুনিতে না থাকলেও শেষ রাতে ফিরে যোগদেন কপিলমুনি যুদ্ধে।
যুদ্ধের পরিকল্পনা :
খুলনাঞ্চলের সর্ববৃহৎ রাজাকার ঘাঁটি ধ্বংস করতে তালা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের প্রধান ইউনুস আলী ইনু মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে জীবন বাজি রেখে ঘাঁটিটি দখলে সহযোদ্ধাদের শপথ করান। চুড়ান্ত পরিকল্পনার আগে সহযোদ্ধাদের নিয়ে ক্যাম্পটি রেকি করেন তিনি। এর একদিন পর তালা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। এদিন তারা মুক্তিযোদ্ধা ইনুকে নাপেয়ে তথ্যানুযায়ী মাগুরায় ঢুকে ৩৫ নীরিহ গ্রমবাসীকে হত্যা করে। এতে শোককে শক্তিতে রুপ দিতে মুক্তিযোদ্ধারা অতি দ্রæত রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের চ‚ড়ান্ত পরিকল্পনা তৈরি করেন। এতে অংশ নেন ইউনুস আলী ইনু, স ম বাবর আলী, গাজী রহমতউল্লাহ, লেফটেন্যান্ট সামসুল আরেফিন, আবদুস সালাম মোড়ল, সাহিদুর রহমান কুটু, আবুল কালাম আজাদ, শেখ শাহাদাৎ হোসেন বাচ্চু, গাজী রফিকুল ইসলাম, শেখ আবদুল কাইয়ুমসহ অন্যান্যরা। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪ ডিসেম্বর রাত ৩টায় ক্যাম্পের তিনদিক থেকে একসঙ্গে আক্রমণ করেন তাঁরা। কপিলমুনির উত্তর-প‚র্ব অংশে মাদ্রা থেকে আক্রমণের দায়িত্বে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ইনু। দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে স.ম বাবর আলী, রহমতউল্লাহ দাদু এবং লেফটেন্যান্ট আরেফিন।
পরিকল্পনা মতে ৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা স.ম বাবর আলী ও আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে ৫০ জনের মুক্তিসেনা দলটি নাসিরপুর ব্রিজ পার হয়ে কপিলমুনি বালিকা বিদ্যালয়ে অবস্থান নেন। রহমতউল্লাহ ও ওমর ফারুক তাঁদের বিস্ফোরক দল নিয়ে রাজাকার শিবিরের দু’ পাশে পৌছায়। আবু ওবায়দার দলটি আরসিএল নিয়ে কানাইদিয়ার পাড় থেকে ক্যাম্পে আক্রমণে প্রস্তত থাকে। ইঞ্জি: মুজিবরের নেতৃত্বে একদল অবস্থান নেন আরসনগর। সেখানকার কালভার্ট উড়িয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তাঁদের। নৌ-কমান্ডো বজলুর রহমান ও হুমায়ুনের নেতৃত্বে একটি দল রাজাকার ক্যাম্পের প্রাচীর ও ম‚ল ঘাঁটিতে বিস্ফোরক লাগানোর দায়িত্বে ছিলেন। মোড়ল আবদুস সালামের নেতৃত্বে রশীদ, মকবুল হোসেন, সামাদ মাস্টার, জিল্লুর রহমানসহ ২০ জনের একটি দল রাজাকার ঘাঁটির ২৫-৩০ গজ দ‚রে অবস্থান নেয়; যাতে তাঁরা রাজাকার ঘাঁটির বাংকারে গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে পারেন। আজিজুল হকের নেতৃত্বে ১০ জনের আরো একটি দল ছিল একটু দ‚রের পাইকগাছার শিববাটি নদীর মোহনায়। ভাসমান মাইন নিয়ে তাঁরা অপেক্ষায় ছিলেন যাতে নৌপথে রাজাকারদের সহায়তায় কোনো গানবোট আসার চেষ্টা করলে সেগুলো উড়িয়ে দেওয়া যায়।
পাল্টা আক্রমণ শুরু :
পরিকল্পনা অনুযায়ী ৪ ডিসেম্বর রাতে যার যার অবস্থান থেকে যুদ্ধ শুরু করলে রাজাকাররাও পাল্টা জবাব দিতে শুরু করে। রাত শেষ হয়ে দিনের আলোতেও চলে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ। দুপুর নাগাদ রাজাকাররা তিন দিক থেকে ঘেরাও হয়ে পড়লেও অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে তারা প্রতিরোধ চলমান রাখে। কৌশলগতভাবে রাজাকাররা ভালো অবস্থানে থেকেও মুক্তিযোদ্ধারা খোলা স্থান থেকে আক্রমণ অব্যাহত রাখেন।
যুদ্ধের প্রথমদিকে নানা আশংকায় এলাকাবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় এগিয়ে না আসলেও যুদ্ধের কৌশল ও দীর্ঘস্থায়ীর লক্ষণে এলাকাবাসী ক্রমান্বয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। তারা যোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় খাবারসহ রাজাকারদের তথ্য, ঘাঁটির বর্ণনা প্রদান, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সহায়তায় সহযোগিতা করেন। একপর্যায়ে মুক্তিসেনা ও জনযুদ্ধে রাজাকাররা সম্প‚র্ণভাবেই একটি ব্য‚হের মধ্যে আটকে যায়। এমনকি রাজাকাররা বাইরের খাবারসহ সকল প্রকার সহযোগিতা বঞ্চিত হয়ে পড়ে।
চতুর্দিকের আক্রমণেও রাজাকাররা প্রথমত দমে না গিয়ে উল্টো মাইক্রোফোনে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে অশ্রাব্য গালিগালাজ ও আত্মসমর্পণের আহŸান জানাতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারাও মাইকে পাল্টা আত্মসমর্পণের আহŸান জানাতে থাকেন। এদিকে যুদ্ধ শুরুর পরদিন এলাকাবাসীর দৃশ্যমান সহযোগীতায় কমান্ডাররা যুদ্ধকৌশলে খানিকটা পরিবর্তন আনেন। অনেকে বিশ্রামে আবার অনেকে যুদ্ধ চালিয়ে যান। রাতের বেলায় গুলি করতে করতে এগোচ্ছিলেন গাজী আনসার। আকষ্মিক একটি গুলি তাঁর বুক বিদীর্ণ করলে শহীদ হন তিনি। ওই রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা আরসিএলের সাহায্যে রাজাকার ক্যাম্পের ছাদের বাঙ্কার উড়িয়ে দেন। ধ্বংস হয় পাঁচিলের অংশবিশেষ। এতে রাজাকাররা ছাদে উঠে যুদ্ধ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়।
যুদ্ধে গাজী রহমতউল্লাহ দাদু সার্বক্ষণিক সামনে থেকে নের্তৃত্ব দিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। কালামের অবস্থান বালিকা বিদ্যালয়ে। এসময় তোরাব আলী ভিন্ন পথে এগোতে গিয়ে আহত হন। তিনি পেটে গুলিবিদ্ধ হলেও তাঁকে চিকিৎসার জন্যে পাঠিয়ে যুদ্ধ চলমান রাখেন অন্যরা। রুহুল আমিন এগুতো গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। রাজাকারদের গুলিতে ইটের দেয়াল ভেঙ্গে তাঁর শরীরে লাগে এবং কুচকিতে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। পরের দিন আহত হন মুক্তিযোদ্ধা খালেক। এতে তাঁর দু’পা ভেঙ্গে যায়। খালেকের আর্তচিৎকারে আব্দুস সালাম এগিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে চিকিৎসায় অন্যত্র পাঠান। খালেক আহত হওয়ার খবরে রাজাকারদের ঘাঁটি লক্ষ্য করে বেপরোয়া গুলিবর্ষণ শুরু করেন আনোয়ার। আকষ্মিক রাজাকারদের ঘাতক বুলেট তাঁর মুখ বিদীর্ণ করলে শহীদ হন তিনি।
আনোয়ারের শহীদের খবরে দ্বিগুণ মনোশক্তিতে মুক্তিযোদ্ধাদের এগিয়ে যান। সাহিদুর রহমান কুটুর ওপর আনোয়ারের লাশ দাফনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রথমে তাঁকে তালার শাহাজাদপুরে কবর দেওয়া হয়। দেশ স্বাধীনের পর অবশ্য পুনরায় তাঁকে তাঁর বাড়ি বেলফুলিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র-গোলাবারুদের সংকট দেখা দেয়। ইতোমধ্যে মুক্তাঞ্চল সাতক্ষীরার শ্যামনগর, কালিগঞ্জ থেকে সুবোল চন্দ্র মন্ডল লঞ্চযোগে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আসেন। নতুন করে পাওয়া অস্ত্র-গোলা-বারুদ এবং এলাকাবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থনে মুক্তিযোদ্ধারা আরো বীরদর্পে রাজাকারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। পর্যুদস্ত রাজাকাররা একপর্যায়ে প্রস্তাব দেন যে, ‘আমরা বাবর আলীর সাথে আত্মসমর্পণের কৌশল নিয়ে কথা বলতে চাই।’ কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা তাদের প্রস্তাবে আস্থা রাখতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধ ওমর ফারুককে বাবর আলী পরিচয়ে রাজাকারদের সঙ্গে কথা বলতে পাঠানো হয়। এতে তারা অবাধে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দাবি করলে আলোচনা ভেঙ্গে যাওয়ায় ফের শুরু হয় তুমুল লড়াই।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতীয় সরকারের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির মতে যৌথ কমান্ড গঠিত হলে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানি ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত আক্রমণ শুরু করে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিমান উড়তে দেখা যাচ্ছিল কপিলমুনি থেকেও এতে রাজাকারদের মনোবল আরো ভেঙ্গে পড়ে। রাজাকার শিবির দখল যখন সময়ের ব্যাপার মাত্র, তখন রাজাকাররা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে সাদা পতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পন করলে ৯ ডিসেম্বর তাদের আটক করা হয়। এসময় দেখা যায়, রাজাকারদের অনেকেই রাতের আঁধার ও যুদ্ধের মধ্যে পালিয়ে গেছে।
মুক্তিযোদ্ধা ইউনুস আলী ইনুর মতে, ধৃত রাজাকারদের সংখ্যা ছিল ১৭৭। তবে তাঁরা শীর্ষস্থানীয় দু’জন রাজাকারকে ধরতে পারেননি। এরা হচ্ছে ইসলামী ছাত্রসংঘের তখনকার খুলনা জেলার প্রেসিডেন্ট মতিউর রহমান এবং রাজাকার কমান্ডার শেখ আনসার আলী। এই আনসার আলী পরবর্তীকালে জামায়াতে ইসলামীর নেতা এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
রাজাকারদের ঘাঁটি দখলের পর মর্মান্তিক দৃশ্য :
রাজাকারদের ঘাঁটি দখলের পর সেখানে একের পর এক মর্মান্তিক দৃশ্য চোখে পড়ে। একটি কক্ষে দেখা যায়, যীশুর মতো ঘরের দেয়ালে পেরেক ঠুকে রাখা হয়েছে তালা উপজেলার মাছিয়ারা গ্রামের রহিম বক্স গাজীর ছেলে সৈয়দ গাজীকে। তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধার বার্তাবাহক। রাজাকার বাহিনীতে নাম লিখিয়ে তিনি ক্যাম্পের খবর বাইরে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাচার করতেন। একসময় তাঁর প্রকৃত পরিচয় জানতে পেরে রাজাকাররা তাঁর গোটা শরীরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে সেই কাটা জায়গায় লবণ পুরে দেয় এবং যীশু খ্রিস্টের মতো হাতে-পায়ে পেরেকবিদ্ধ করে দেয়ালে সেটে রাখে।
ঘাঁটি থেকে উদ্ধার করা কাগজপত্রে দেখা যায়, ওই রাজাকার ক্যাম্পের মাধ্যমে ১ হাজার ৬ শত ১ জনকে হত্যা করা হয়েছে। পরবর্তীতে হত্যার জন্য কপিলমুনিসহ আশপাশের আরো ১ হাজার জনের তালিকা উদ্ধার হয় ঘাঁটিতে। এদিকে রাজাকারদের আটক ও ঘাঁটি দখলের খবর দ্রæত আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে বহু সংখ্যক মানুষ এসে ভিড়জমায় কপিলমুনি হাইস্কুল মাঠে।
মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদুল কাইয়ুম সে দিনের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘চারদিক থেকে মুক্তিকামী মানুষ পিঁপড়ের সারির ন্যায় সেদিন কপিলমুনি সহচরী বিদ্যা মন্দিরের মাঠে জড়ো হয়। এসময় তাঁরা রাজাকারদের তাদেও হাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে দাবি জানাতে থাকেন। প্রতি প্রত্যেকেই একেক জন রাজাকারকে দেখিয়ে তাদের হাতে নির্যাতনের বর্ণনা দিতে থাকেন। এসময় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আটককৃতদের নিরাপত্তা নিশ্চিতপূর্বক বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে হস্তান্তর করতে ঘোষণা দিলে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন উপস্থিত এলাকাবাসী।
জনতার আদালতে কপিলমুনিতেই রাজাকারদের বিচার :
এলাকাবাসী তাদের কাউকে অন্যত্র নিয়ে যেতে রাজি হননি। অবশেষে জনতার চাপের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা আটককৃত রাজাকারদের কপিলমুনিতেই বিচারের সিদ্ধান্ত নেন। এক পর্যায়ে আদালত বসিয়ে প্রতিজন রাজাকারের বিরুদ্ধে আলাদা ভাবে সাক্ষ্য-প্রমাণ চাওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে শুরু হয় বিচার প্রক্রিয়া। তাঁরা হলেন, শেখ কামরুজ্জামান টুকু, ইউনুস আলী ইনু, স ম বাবর আলী, গাজী রহমতউলাহ, স ম আলাউদ্দিন, মোড়ল আব্দুস সালাম, আবুল কালাম আজাদ ও শেখ আব্দুল কাইয়ুম। জনগণ প্রত্যেক রাজাকারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করেন। একজন রাজাকার বাদে সেখানকার বাকি রাজাকারদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ উত্থাপিত হয়। অভিযোগগুলোর মধ্যে ছিল হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধর্ষণ প্রভৃতির মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ। এই অভিযোগের পক্ষে জনতা সাক্ষ্য-প্রমাণও হাজির করেন। সকাল ৯টা থেকে শুরু করে সন্ধ্যা অবধি চলে এই বিচারকাজ। এখানে অপরাধীদের পক্ষে সওয়াল এবং যুদ্ধাপরাধী এসব দুর্বৃত্তদের মুক্তিযোদ্ধারা বা সাধারণ নাগরিকরা বিচার করতে পারে না মর্মে যুক্তি তুলে ধরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শেখ কামরুজ্জামান টুকু একটি দীর্ঘ বক্তব্য উপস্থাপন করলে উপস্থিত ২০/৩০ হাজার মানুষ আটক রাজাকারদের উপর হামলে পড়ে। এতে অনেকের মৃত্যু হয়।
রাজাকারদের শেষ পরিণতি :
মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদুল কাইয়ুমের মতে, মানুষের সকল ক্ষোভ রাজাকারদের সাজার মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয়। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, রাজাকারদের ১৫৬ জনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাড় করিয়ে তাদের গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। মতান্তরে ১৫১ জন।
এছাড়া জনগণের রায়ে ‘সাজাপ্রাপ্ত রাজাকারদের মধ্যে সাধারণ জনতা বেঁছে বেঁছে ১১ রাজাকারকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে তাদেরকে গুলি করে হত্যার পরিবর্তে কষ্ট দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করার দাবি তোলেন। এক পর্যায়ে তারা এদেরকে ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনিতে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে। এমনকি তাদেরকে গোটা শরীর বেøড দিয়ে চিরে তাতে লবণ পুরে মাঠে ফেলে রাখে।
বীরমুক্তিযোদ্ধা মোড়ল আব্দুস সালাম জীবদ্দশায় বলেছিলেন, শীর্ষস্থানীয় ১১ রাজাকারের মধ্যে আট জন ছিলেন, মাওলানা আফছার, সৈয়দ ফকির, আফতাব কারী, আবদুল মালেক, মতি মিয়া, শেখ হাবিবুর রহমান, আমিনউদ্দিন মুন্সী এবং মশিউর রহমান। এদের সবারই বাড়ি ছিল কপিলমুনি এবং সংলগ্ন এলাকায়। মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ায় রাজাকারদের মৃতদেহগুলো স্কুল মাঠে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো থাকে। লাশগুলোর দায়িত্ব আব্দুস সালাম মোড়লের ওপর দিয়ে শেখ কামরুজ্জামান টুকু অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে খুলনা অভিমুখে রওনা দেন। এতগুলো লাশ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সালাম এক বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। তিনি এলাকায় মাইক দিয়ে ঘোষণা করেন, লাশগুলো তাদের স্বজনরা এসে নিয়ে যেতে পারে। রাতের বেলা লাশগুলো রক্ষার জন্য পাহারারও ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ঐদিন স্বজনদের কেউই লাশ নিতে আসেনি। পরের দিন ২/৩ টি লাশ নিয়ে যায় স্বজনরা। পরে রাতের পাহারা তুলে নিলে কিছু লাশ নিলেও অনেক লাশ পড়ে থাকায় তাতে পচন শুরু হয় পক্ষান্তরে রাজাকারের লাশ দাফনে অনাগ্রহ থাকায় অনেকের লাশ কপোতাক্ষ নদী ও খিছু লাশের মাঠের পাশেই একসাথে গণকবর দেওয়া হয়।
ঐতিহাসিক কপিলমুনির সরকারি জায়গা দখল :
সর্বশেষ গত ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত দিবসের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রলায়ের মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক কপিলমুনিতে সরকারি জায়গায় মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর এর টেন্ডার ও ওয়ার্ক অর্ডার হলেও নির্ধারিত জায়গাটি নিজেদের দাবি করে তা দখলে নিয়ে সেখানে একদিকে পাকা ইমারত নির্মাণের কাজ চলমান অন্যদিকে মামলা হওয়ায় বন্ধ রয়েছে এর কার্যক্রম।
এ ব্যাপারে পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ বেগম বলেন, স্থানীয়ভাবে আজ কপিলমুনিতে মুক্ত দিবস পালিত হবে। এছাড়া নির্ধারিত স্থানে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেখানে মামলা নয় বরং অধিগ্রহন জটিলতায় এর কার্যক্রম থমকে গেছে। ইতোমধ্যে অধিগ্রহনের সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন হয়েছে। অচিরেই এর কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হবে।