খুলনা, বাংলাদেশ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৮৬

একটি দুঃস্বপ্ন

মাজেদা হক

শেষ রাতে একটা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে শহর আলী। একটানা গো গো শব্দ বের হয় গলা দিয়ে। পা দু’টো আছড়াতে থাকে। মনে হয় কে যেন তার দু’পা চেপে ধরে গলাটিপে মারার চেষ্টা করছে। তার হাত পা ছোড়াছুড়িতে পাশে ঘুমিয়ে থাকা ফুলবানুরও ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে তাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙ্গাতে চেষ্টা করে বললো-

কি হইলো আজ আবার কোন খারাপ স্বপ্ন দেখছেন? এ প্রশ্নের কোন উত্তর দেয়না শহর আলী। তার সব কিছুই যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। চোখ মেলে বিবর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। ফুলবানু আবার একই প্রশ্ন করে, কি যে হইলো, কথার উত্তর দেন না ক্যান? আজ আবার কি কোন দুঃস্বপন দেখছেন? কি যে অইলো, আপনি রোজ রোজ শুধু খারাপ স্বপন দেখেন, ফুলবানুর এত কথায় শহর আলী যেন জ্ঞান ফিরে যায়। ঢোক গিয়ে বলে, হ আইজ আবার একটা খারাপ স্বপন দেখলাম।

কতদিন আমি বলছি বড় মসজিদের ইমাম সাহেবের তন একটা তাবিজ লন। তাতো হোনেন না। একটা তাবিজ কবজ সব সময় সাথে থাকোন ভালো। সব বালা মুসিবত কাইট্যা যায়। এবারও ফুলবানুর কথার কোন উত্তর দ্যায় না শহর আলী। পাশ ফিরে শোয়ার চেষ্টা করে। গত ৩৫ বৎসর যাবত যে দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে, কার কাছে বলবে সে কাহিনী? কোথায় বর্ণনা করে একটু হালকা হবে সে? কোন্্ দোয়া তাবিজ তাকে উদ্ধার করবে এই মহা মানসিক অশান্তি থেকে?

শেষ রাতে সে আধো ঘুমের মধ্যে দেখছে সেদিনের মত আজও শায়েলা তার পা’ দুটি খুব জোরে জড়িয়ে ধরে বলছে,-চাচা আপনি আমাকে বাঁচান। আপনি আমাকে পাক সেনাদের হাতে তুলে দেবেন না। আপনি আমার বাবার মত। আমার এতো বড় সর্বনাশ আপনি করবেন না। আমার ইজ্জত রক্ষা করলে আল্লা আপনার ভাল করবে।

পাশে দাঁড়িয়ে শায়েলার বাবা মা যেন নিরব দর্শক। মা আঁচলে চোখ মুছে বলছে, আপনি আমাদের একান্ত নিজের লোক। শায়েলার চাচার মত। আপনি আমাদের এত বড় সর্বনাশ করতে পারবেন?

আমি কি করুম ভাবীসাব? সকালে শায়েলা যখন গান গায় তখন ওরা তারে দেইখ্যা ফালাইছে। ওরা তার গান শোনবার চায়। আমার সাথে যাইয়া দু’চারটে গান শোনাইয়া আইবো। ওরা শায়েলার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।

কিন্তু শায়েলা প্রবলভাবে মাথা নেড়ে বার বার বলতে লাগলো, না চাচা আমি কিছুতেই যাব না। আপনি আমায় বাঁচান।
শহর আলী মুন্সী স্থানীয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। স্থানীয় আর্মি ক্যাম্পের পাকসেনাদের সাথে তার বেজায় দহরম-মহরম, আনাগোনা, যাওয়া আসা। এ বাড়ীর খাসী, ও বাড়ির মুরগী, এ ফার্মের ডিম, ওর ক্ষেতের সব্্জি সে সব সময় আর্মি ক্যাম্পে ভেট দিয়ে আসে। পাক আর্মিরা দেশকে শক্র মুক্ত করে পাক পবিত্র একটা দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিত।

সুতরাং তাদের প্রয়োজনমত সব কিছু যোগান দেওয়া শহর আলী পবিত্র কাজ বলে মনে করে। রাতে তাদের সাথে মদ খেয়ে, আমোদ স্ফূর্তি করে শেষ রাতে ঘরে ফেরে। এ দিকে তারা ছাড়া অধিকাংশ লোকই শহর ছেড়ে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে। শুধুমাত্র শান্তি কমিটির শান্তির ছায়ার দু’একজন প্রভাবশালী রয়ে গেছে। তাছাড়া ঘর-বাড়ী, আসবাব পত্রের মায়াও তো আছে। অনেকের ধারণা শহর আলী মুন্সী তাদের একান্ত আপনজন। বিপদ-আপদে সেই তাদের রক্ষা করবে।

শায়েলার বাবা রশীদ চৌধুরী স্থানীয় সরকারি স্কুলের ইংরাজীর শিক্ষক। শহর আলীর প্রতিবেশী। তাকেও রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সে। সুতরাং রশীদ চৌধুরীর দৃঢ় বিশ্বাস কেউ তার টিকিও ছুঁতে পারবেনা। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। সন্ধ্যাবেলা শহর আলী এসে শায়েলার বাবা রশিদ চৌধুরীকে ডেকে আস্তে আস্তে কি যেন বললো। রশিদ সাহেব রাগে চিৎকার করে বললেন,-কি তোমার এতো বড় সাহস? আমার মেয়ে যাবে আর্মি ক্যাম্পে গান শোনাতে? তুমি এত বড় জঘন্য কথা মুখে আনলে কোন সাহসে? আমি তোমার জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।

বড় ভাই, রাগ কইরেন না। চিৎকার কইর‌্যা লোক জড়ো কইরেন না। আমি সাথে কইর‌্যা লইয়া যামু, আবার সাথে কইর‌্যাই ফিরাইয়া আনুম। ওরা একটু গান শুনবার চায়। ওদের কথা না শুনলে ওরা সারা পাড়ায় আগুন দিয়া দিবো।
রশিদ সাহেব কেবলই মাথা নাড়েন আর বলেন,-না না এ হয়না, এ হয়না। আমার মেয়েকে আমি কি করে পাঠাবো। ঢাকা হতে জামাই এসে শুনলে কি বলবে?

আপনার জামাই ফারুক আর কোনদিন আইবো না। হেতো মুক্তিযুদ্ধে গ্যাছে।
কে কইলো মুক্তিযুদ্ধে গেছে?-চেঁচিয়ে ওঠে রশিদ সাহেব।

পাড়ার হক্কল লোকই জানে আপনার জামাই ফারুক ঢাকাতন মুক্তিযুদ্ধে গ্যাছে। এখন ওরা আগর তলায় ট্রেনিং লয়। ২৫ শে মার্চের রাতে যখন ঢাকার ছাত্রহলে আর্মিরা রেইড করে তখন তো বহু ছাত্র মারা গিছিলো। যারা বেঁচে আছিলো তারা অনেকেই আখাউড়া বর্ডার পার হয়ে আগরতলায় যায়। আপনের জামমাইও ওদের সাথে গ্যাছে। মহল্লার হক্কল লোকরে জিগান, তারা জানে কিনা? আমার ভয়েই পাক আর্মিরা কিছু কয়না।

শহর আলীর কথা শুনে মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় রশীদ সাহেবের। ঠিক যেন হলুদ-লবণ ছাড়া সেদ্ধ করা বেলে মাছ। মরা মানুষের মত রক্তহীন ফ্যাকাশে। আগের কথার জের ধরে শহর আলী আবার বলতে থাকে,
এতদিন মহল্লার সবকিছু জ্বালায়ে পোড়ায়ে শ্যাষ কইর‌্যা দিত। আপনে অমত কইরেন না ভাইজান। আমি রাতের আন্ধারে ওরে চুপি চুপি লইয়া যামু আবার ঘন্টা দুই পরে জলসা শ্যাষ হইলে সাথে কইর‌্যা ফিরাইয়া আনুম। কাক-পক্ষীও ট্যার পাইবো না।
কিন্তু গোল বাঁধালো শায়েলা নিজে,
না চাচা আমি যাব না। জান থাকতে কিছুতেই যাব না। আমি কি বাঈজী না নর্তকী? পাকসেনাদের ক্যাম্পে যাব গান শোনাতে?
শহর আলী যতই তাকে বোঝাতে চায় তার একই কথা, না চাচা আমি যাবনা।

শেষ তার পা দুটি জোরে জড়িয়ে ধরে বলে, চাচা আপনি আমার আব্বার মত। আমাকে রক্ষা করার দায়িত্বও আপনার। আমাকে আপনি বাঁচান।
তুই না গেলে তর মা-বাপ সব শ্যাষ হইয়া যাইবে। রাতে আগুন জ্বালাইয়া ওরা মহল্লা পোড়ায়া দিবে। সবকিছুই জ্বইল্যা-পুইড়্যা খাক হইয়া যাইবো। তুই কি চাস তোর জন্য মহল্লার সবার ক্ষতি হোক?

সেদিন জোর করে পা ছাড়িয়ে নিয়েছিল শহর আলী। সে সময় গল্লামারী ব্রিজের ওপাশে বিলের মধ্যে শুধু পূর্ব পাকিস্তান খুলনা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার ষ্টেশন ও আবহাওয়া অফিস ছিল। ছিলনা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বর্তমানের ঘন লোকবসতি, সুরম্য অট্টালিকা, হাট-বাজার। যে দু’চার জনের বসবাস ছিল তারাও যুদ্ধের শুরুতে প্রাণ ভয়ে ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। বেতার ষ্টেশনেই ছিল আর্মি ক্যাম্প। পরদিন সকালে টোকাই মুন্না ছুটতে ছুটতে এসে সংবাদ দিলো রেডিও ষ্টেশনের পাশের বিলে সায়েলার লাশ ভাসছে। ক্ষ-বিক্ষত অর্ধ উলঙ্গ লাশটি প্রতিবেশীরা উদ্ধার করে নিয়ে এলো।
পরের ইতিহাস খুবই সংক্ষিপ্ত। প্রাণপ্রিয় সন্তানকে এভাবে বিসর্জন দিয়ে ক্ষোভে, দুঃখে, লজ্জায় রশিদ চৌধুরী আর বেশিদিন বাঁচেননি বা এ বেদনা বয়ে বেড়াতে পারেননি।

শহর আলীও তাই জবাবদিহিতার হাত হতে নিষ্কৃতি পেয়েছিল। সে এখন একজন নামী-দামী রাজনীতিবিদ। গত ইলেকশানে জিতে সে সংসদ সদস্য পদলাভ করেছে। আগামী ইলেকশানে জিততে পারলে হয়তো মন্ত্রীও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেই দুঃস্বপ্ন আজও তাকে তাড়া করে নিয়ে ফিরছে। এখনও রাতে মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখে শায়েলা তার পা দু’টি জোরে চেপে ধরে বলছে, চাচা আপনি আমাকে বাঁচান। আল্লাহ্্ আপনার ভাল করবে।

পূবের আকাশ ফরসা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে। ডিমের কুসুমের মত সূর্যটা লালচে আভা ছড়াতে ছড়াতে আকাশে উঁকি দিচ্ছে। শহর আলী ভাবে সেদিনও কি সূর্যটা এমনি লাল ছিল? এমনি করেই লাল আগুনের মত রঙ ছড়াতে ছড়াতে পূব আকাশের বুকে উঁকি দিয়েছিলো? তারপরে ভারী পা দুটো খাট হতে নামিয়ে বলে,-ফজরের আজান অইছে অনেকক্ষণ। নামাজ কাযা অইয়া যাইবো। যাই মসজিদে যাই। নামাজ পড়ি গা।




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!