আমদানি ব্যয় যে হারে বেড়েছে, সেই হারে বাড়েনি রপ্তানি। আশানুরূপ রেমিট্যান্সও আসেনি। ফলে দেশের বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। চাহিদা অনুযায়ী ডলারের জোগান না থাকায় প্রয়োজনীয় এলসি (ঋণ পত্র) খুলতে পারছে না ব্যাংকগুলো। আবার আমদানির অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছে অনেক ব্যাংক।
এমন পরিস্থিতিতে বাজার ‘স্থিতিশীল’ রাখতে রেকর্ড পরিমাণ ডলার বিক্রি করে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারপরও ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। বাড়ছে ডলারের দাম আর বিপরীতে কমছে টাকার মান।
চলতি অর্থবছরের সাত মাস শেষ না হতেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৮৫০ কোটি ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে পুরো অর্থবছরেও রিজার্ভ থেকে এই পরিমাণ ডলার বিক্রি করেনি নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটি।
সাত মাস না যেতেই ৮৫০ কোটি ডলার বিক্রি
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, সমস্যা সমাধানে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের সাত মাস শেষ না হতেই আমদানি দায় পরিশোধের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৮৫০ কোটি (৮.৫০ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে পুরো অর্থবছরেও রিজার্ভ থেকে এই পরিমাণ ডলার বিক্রি করেনি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
২০২১-২২ অর্থবছরে মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি (৭.৬২ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছিল।
এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ায় দর ধরে রাখতে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়াও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত অর্থবছরের আগে সেটিই ছিল সর্বোচ্চ ডলার কেনার রেকর্ড।
রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এখন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে ডলার বিক্রি করা ছাড়া উপায় নেই। কারণ এ অবস্থা থেকে রাতারাতি উন্নতি করা সম্ভব না। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠিন সময় যাচ্ছে। কৌশলে এই সংকট মোকাবেলা করতে হবে।
ডলারের মূল্য বাড়লে দেশে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পায়। এজন্য বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংকের কাছে রিজার্ভ থেকে প্রচুর পরিমাণ ডলার বিক্রি অব্যাহত রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সাবেক এ গভর্নর জানান, আমদানি জিরো করা যাবে না। উৎপাদন বাড়াতে হলে বিভিন্ন মেশিনারি আনতে হবে। রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল আমদানি করতে হবে। এজন্য ডলার লাগবেই। এখন এই ডলার জোগান কিভাবে দেবে এটাই বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য প্রথমে রপ্তানি আয় দ্রুত দেশে আনার ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি ডলার পাচার রোধ করতে হবে। এখনো খোলা বাজার ডলার কেনাবেচা হচ্ছে। অনেক ডলার দেশের বাহিরে চলে যাচ্ছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। পাশাপাশি এফডিআই (দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ) ও বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ৩২.৪৭ বিলিয়ন ডলার
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ডলারের মূল্য বাড়লে মুদ্রা বিনিময় হারের মাধ্যমে দেশে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পায়। এজন্য ডলারের চাহিদা বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংকের কাছে রিজার্ভ থেকে প্রচুর পরিমাণ ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের হিসাবে এখন প্রকৃত রিজার্ভ আছে সাড়ে ২৪ বিলিয়ন ডলার। যা গত ৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সবশেষ ২৩ জানুয়ারি রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের কাছে ৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাড়ার পরও রিজার্ভ সাড়ে ৩২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। দিনশেষে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩২ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যদি রিজার্ভ হিসাব করা হয় তাহলে এটি আরও আট বিলিয়নের মতো কমে যাবে। সেই হিসাবে এখন প্রকৃত রিজার্ভ আছে সাড়ে ২৪ বিলিয়ন ডলার। যা গত ৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৫ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর থেকে রিজার্ভ কমে এ পর্যায়ে নেমেছে। এর আগে ধারাবাহিকভাবে যা বাড়ছিল। ১০ বছর আগে ২০১৩ সালের জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয়েছিল ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে আরো বেড়ে ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নতুন মাইলফলক অতিক্রম করে দেশের রিজার্ভ। এরপর তা বেড়ে ২০২১ সালের আগস্টে প্রথমবারের মতো ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলার হয়; রিজার্ভের এ অংক ছিল ইতিহাসের সর্বোচ্চ। এরপর আর রিজার্ভ ধরে রাখতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।
দফায় দফায় বৈঠকে নির্ধারণ হচ্ছে ডলারের দাম
এদিকে ডলার সংকট প্রকট হলে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এই দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি ও বাফেদার ওপর। এরপর দুই সংগঠনের নেতারা বিভিন্ন লেনদেনে ডলারের সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করে আসছে। শুরুতে রপ্তানি আয়ে ডলারের সর্বোচ্চ দাম ছিল ৯৯ টাকা ও প্রবাসী আয়ে ১০৮ টাকা। আর ডলারের পাঁচ দিনের গড় খরচের চেয়ে ১ টাকা বেশি দামে আমদানি দায় শোধ করতে বলা হয়। পরে বিভিন্ন সময় দফায় দফায় বৈঠক করে নতুন দর নির্ধারণ করা হচ্ছে।
সবশেষ ১ জানুয়ারি রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে ডলারের দাম আরও ১ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। এবিবি ও বাফেদা সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম ১০২ টাকা। প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম ১০৭ টাকা।
এবিবি ও বাফেদা নয় সংকটে ডলারের দাম বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও। এখন প্রতি ডলার ১০০ টাকা করে বিক্রি করছে। অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক জরুরি পণ্য আমদানিতে যে ডলার বিক্রি করছে, তার প্রতি ডলারের মূল্য ১০০ টাকা।
সোমবার এই দরেই রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের কাছে ৫ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা। এক বছর আগেও এই ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা।
তবে খোলা বাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১১১ টাকা। গেল বছর কার্ব মার্কেটে ডলার ১২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল।