‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ উক্তিকে জনপ্রিয় করতে প্রথমে জাগদল পরে বিএনপি’র আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে জে. জিয়াউর রহমানের রাজনীতি শুরু, ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এ দলের দর্শণ। ১৯ দফার মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচির শুরু হয়। এ দলের আত্মপ্রকাশের পর থেকে উপকূলবর্তী জেলা খুলনায় গত ৪৪ বছরের সফলতা ব্যর্থতা দুটোই রয়েছে। দলে বিভিন্ন সময়ে জোয়ার ভাটা হলেও খুলনায় সাংগঠনিক ভীত শক্ত করতে সক্ষম হয় দলটি।
১৯৭৫-৭৭ অবধি দেশে সামরিক শাসন বিরাজ করে। এ প্রেক্ষাপটে সেনা প্রধান রাজনৈতিক দল গঠনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। মুসলিম লীগ, ন্যাপ (ভাসানী) ও পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টি (এমএল) থেকে আসা নেতা কর্মীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে বিএনপি নামক রাজনৈতিক দল। মূলত: যোগাযোগ মন্ত্রী খান এ সবুরের মৃত্যুর পর মুসলিম লীগের ভাটা পড়লে বিএনপির পাল্লা খুলনায় ভারী হতে থাকে। দলের প্রথমার্ধে অবসর প্রাপ্ত জজ আমীর আলী জোয়ারদার, ন্যাপ (ভাসানী) থেকে শেখ তৈয়েবুর রহমান, মোঃ আশরাফ হোসেন, এম নুরুল ইসলাম, সৈয়দ ঈসা, গাজী আব্দুল বারী, এম মুনসুর আলী, জাসদ থেকে শেখ রাজ্জাক আলী, মনিরুজ্জামান মনি, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি থেকে শফিকুল আলম মনা, অন্যান্য সংগঠন থেকে কাজী সেকেন্দার আলী ডালিম, শেখ মুজিবুর রহমান, শাহরুজ্জামান মোর্তজা, নুরুজ্জামান খোকন, কাজি আমিনুল হক, রেজাউল করিম, বিএনপি ও যুবদলে যোগদান করেন। কাজী সেকেন্দার আলী ডালিম ও সৈয়দ ঈসা দল ত্যাগ করলেও পরে আবার ফিরে আসেন। যদিও তাদের অবস্থান পাকাপক্ত হয়নি।
দলকে শক্তিশালী করার জন্য প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জে. জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ১৯ মে থেকে ১৯৮০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৮ বার খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট মহাকুমা সফর করেন। তার উল্লেখযোগ্য সফরগুলো মধ্যে রয়েছে, তেরখাদা, রূপসার বেলফুলিয়া, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ, দেবহাটা ও খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলস।
তিনি ১৯৭৭ সালের ১০ এপ্রিল খুলনা শহর রক্ষা প্রকল্প, ১৯৭৯ সালের ১০ নভেম্বর এখানে কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ, ১৯৭৮ সালের ১৪ এপ্রিল বিমান বন্দর ও ১৯৭৯ সালের ২৪ অক্টোবর খুলনা-বরিশাল সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
১৯৭৯ সালে আজকের বাগেরহাট-১ আসনে সৈয়দ মোজাহিদুর রহমান, একই বছর বাগেরহাট-২ আসনে এএসএম মোস্তাফিজুর রহমান, ২০০১ সালে এমএ এইচ সেলিম, ১৯৭৯ সালে বাগেরহাট-৩ আসনে আফতাব উদ্দীন হাওলাদার, খুলনা-১ আসনে ১৯৭৯ সালে প্রফুল্ল কুমার শীল, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের ১২ জুন খুলনা-২ আসনে শেখ রাজ্জাক আলী, ২০০১ সালে একই আসনে দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়া, ২০০৮ সালে নজরুল ইসলাম মঞ্জু, খুলনা-৩ আসনে ১৯৭৯, ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে মোঃ আশরাফ হোসেন, খুলনা-৪ আসনের উপ-নির্বাচনে ১৯৭৯ সালে একেএম জিয়া উদ্দিন পল্টু, ২০০১ সালে এম নুরুল ইসলাম, ১৯৭৯ সালে খুলনা-৬ আসনে শেখ রাজ্জাক আলী, সাতক্ষীরা-১ আসনে ২০০১ সালে হাবিবুল ইসলাম হাবিব, ১৯৭৯ সালে সাতক্ষীরা ২ আসনে সামসুল হক, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরা-৩ আসনে অধ্যক্ষ আলী আহমেদ ও ১৯৭৯ সালে সাতক্ষীরা-৪ আসনে ডা. আফতাবুজ্জামান দলীয় মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
জে. এরশাদের সামরিক শাসনের আওতায় ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। ১৯৯১ সালে খুলনা-২, খুলনা-৩ আসনে বিএনপি জয়ী হয়। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী সব ক’টি আসনে জয়ী হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত খুলনা-২ আসন ছাড়া বাকি আসনগুলো হাত ছাড়া হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। এছাড়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে দল ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে।
আত্মপ্রকাশের পর থেকে উন্নয়নের দিক থেকে সফলতা ১৯৭৯ সালে কয়রা থানার আত্মপ্রকাশ, পরবর্তীতে মেডিকেল কলেজ (সোনাডাঙ্গা, জে. জিয়ার শাসনামলে) স্থাপন হয়। ১৯৯১ সালের পর থেকে কয়রা উপজেলা বিদ্যুতায়ন, কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলায় আদালত স্থাপন, এম এম সিটি কলেজ, সুন্দরবন আদর্শ মহাবিদ্যালয়, কুয়েট, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কার্যক্রম, সবুরুন্নেছা কলেজ, কলেজিয়েট গার্লস স্কুল স্থাপন, জিয়া হল, বায়তুন নুর মসজিদ কমপ্লেক্স, নগর ভবন, খান এ সবুর মহিলা মাদ্রাসা স্থাপন বিএনপির বড় সফলতা।
ব্যর্থতার দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় ১৯৮০ সালে খুলনা জেল খানায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে একাধিক বন্দী নিহত, খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলস, কেটিএম, হার্ডবোর্ড মিলস ও দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি উৎপাদন বন্ধ।
আত্মপ্রকাশের পর ১৯৭৯ সালে খুলনাভিত্তিক রাজনীতিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ও সংসদ সদস্য শেখ রাজ্জাক আলী, সাতক্ষীরা ভিত্তিক রাজনীতিতে বস্ত্রমন্ত্রী এম মুনসুর আলী ও মৎস্য প্রতিমন্ত্রী ডা. আফতাবুজ্জামানের মধ্যে দন্ড প্রকট ছিল। ২০০১ সালের পর খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শেখ তৈয়বুর রহমানের সাথে তরুণ নেতা নজরুল ইসলাম মঞ্জুর বিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দুই গ্রুপ ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেয়। সাবেক স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী ও উপ-নির্বাচনে সংসদ সদস্য আলী আসগর লবী সেসময় তৈয়েবুর রহমানের পক্ষে অবস্থান নেন।
এবারের নতুন কমিটি আসার আগে স্থানীয় পর্যায়ে দলের দুই গ্রুপ পৃথক পৃথক কর্মসূচি পালন করে। গেল বছর ডিসেম্বরে আকস্মিকভাবে নগর ও জেলা কমিটি ভেঙে দেওয়ার পর দুটি গ্রুপ প্রকাশ্যে ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেয়। বর্তমান কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন নগর কমিটির আহবায়ক এসএম শফিকুল আলম মনা ও জেলায় আমীর এজাজ খান। এই অংশকে নেপথ্যে রয়েছেন কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা রকিবুল ইসলাম বকুল। মহানগর বিএনপির সাবেক নেতৃবৃন্দের ব্যানারে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন বিলুপ্ত থানা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা। এ অংশের নেপথ্যে রয়েছেন নগর শাখার সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সাবেক মেয়র মনিরুজ্জামান মনি।