যশোরের ঝিকরগাছার দুটি পরিবার জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। একটি দেওয়ানি মামলাকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে মামলা চালিয়ে যাচ্ছে পরিবার দুটি। কোন সমঝোতা বা নিষ্পত্তি করতে পারেনি ওয়ারেশ যাঁরা। অথচ মূল মামলার বাদি-বিবাদি অনেক আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন।
যশোরের নিম্ন আদালত থেকে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে ১১.০৬.১৯৭৯ তারিখে করা ৫০৬/৭৯ নম্বরের ভাগ বন্টনের মামলাটি। পাল্টাপাল্টি মামলায় দীর্ঘসূত্রতার মাঝেও সমঝোতায় আসতে পারেননি তাঁরা। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও জরাজীর্ণ ভবনের সংস্কার কিংবা স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করতে পারছেন না ওয়ারেশরা। ফলে, চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে তাদের।
মামলা সূত্রে জানা যায়, ‘মামলার বাদি-বিবাদি উভয়পক্ষ সৃষ্ট মামলার আগে থেকেই নিজ নিজ অংশে আপস মতে শান্তিপূর্ণ ভোগদখলে ছিলেন। অর্থাৎ, মূল মামলার বাদি আব্দুল আজিজ ও তার বৈমাত্রেয় ভাই বিবাদি আব্দুল লতিফের বাবা জয়নাল আবেদীনের জীবদ্দশা থেকে।
এই মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ বিবাদিপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের আপিলেট ডিভিশনে প্রতিকার চেয়ে আপিল মামলা করেছেন। যার নম্বর-১১৮৪/২০১৯। দীর্ঘ ১৭ বছর পর হাইকোর্ট এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। যার নম্বর-৬৩০৮/২০০১। তারিখ ০৬.০৮.১৮।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, হাইকোর্টের বিজ্ঞ বিচারক মো. এমদাদুল হক আজাদের আদালত বাদি-বিবাদি দু’ভাইয়ের পিতা-মৃত জয়নাল আবেদীনকে জমির মালিকানা থেকে বেনামদার সাব্যস্ত করে তার মূল দলিল বাতিল করেন এবং তার জিবদ্দশায় তিনি মূল দলিল থেকে বিভিন্ন সময়ে যেসব জমি হস্তান্তরিত করেছেন সেগুলি রদ ও রহিতের আদেশ দেন।
এর আগে ঝিকরগাছা সহকারী জজ আদালতের বিজ্ঞ বিচারক শেখ আবু তাহেরের আদালত ০৮.১০.১৯৯৮ বিবাদি আব্দুল লতিফের পক্ষে এবং যশোরের যুগ্ম জেলা জজ আদালতের বিজ্ঞ বিচারক মো. মোতাহার হোসেনের আদালত ৩০.১০.২০০১ তারিখে বাদি আব্দুল আজিজের পক্ষে পৃথক রায় ঘোষণা করেন।
আপিল মামলার বাদি ঝিকরগাছা রেলস্টেশন রোডের মৃত আব্দুল লতিফের বড় ছেলে মো. তরিকুল ইসলাম তারিক। বিবাদিরা হলেন নেওয়াজ মোহাম্মাদ জাহেদী গং। তারা দু’জন চাচাতো ভাই। এই মামলার মূল বাদি-বিবাদি দু’ভাই বহু আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন। বাবার রেখে যাওয়া ১৩ শতক জমির ওপর বসতভিটায় ১৯৫৯ সাল থেকে বাদি-বিবাদি দু’ভাই সমান সাড়ে ৬ শতক অংশে বসবাস করে এসেছেন। এখন তাদের ওয়ারিশ গং এই সম্পত্তিতে বসবাস করে আসছেন। দু’ভাইয়ের শুধুমাত্র জেদাজেদির কারণেই এই মামলার উৎপত্তি। পারিবারিকভাবে অথবা স্থানীয় এমপি, চেয়ারম্যানের মধ্যস্থতায় উদ্যোগ গ্রহণ করলে অনেক আগেই এই ধরনের মামলা নিষ্পত্তি হওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু উভয় পরিবারের কেউই সমঝোতায় না আসায় আজও মামলাটি সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন।
বর্তমান আপিল মামলার বাদি মো. তরিকুল ইসলাম তারিকের দাবি, মো. জয়নাল আবেদীন ১৫.০৮.৫৯ তারিখে ৭২৫৩ নম্বর কবলা দলিল মূলে মোট ২ একর ৪৩ শতক জমি ক্রয় করার পর থেকে সরকার সেরেস্তায় ১৯৬২ সালে নিজ নাম রেকর্ডভুক্ত করে কর খাজনা প্রদান সাপেক্ষে ভোগ দখলকার ছিলেন। পরবর্তীতে ৭২৫৩ নম্বর কবলা দলিল থেকে ২ একর ৩৫ শতক জমি শিক্ষক হরিপদ পালদ্বিগের কাছে বিক্রি করে দেন। যার রেজিস্ট্রিকৃত দলিল নম্বর-৬৪৭৪ তারিখ- ০৯.০৭.১৯৬২। এই দলিলের শনাক্তকারী ও সাক্ষি বিবাদি আব্দুল আজিজ নিজে। অথচ তিনি তার বাবা জয়নাল আবেদীনকে ৩৮ বছর পরে ওই দলিলের বেনামদার আখ্যায়িত করে আরজি দাখিল করেন। যা হাস্যকর ও অযৌক্তিক। কারণ, জয়নাল আবেদীনের ক্রয়সূত্রে নিজনামীয় কবলা ৭২৫৩ নম্বর দলিল সৃষ্টি হলো ১৫.০৮.৫৯ তারিখে। তার মৃত্যু হলো ১৯৮৭ সালে। জয়নাল আবেদীনের জীবিতকালীন সময়ের ২৮ বছরের মধ্যে বাদি আব্দুল আজিজ কোনো অভিযোগ কিংবা নিজেই ওই জমি জায়গার একক মালিক হিসেবে দাবি করেননি কেন? মামলার বাদির প্রশ্ন।
বিবাদি নেওয়াজ মোহাম্মদ জাহেদী মুঠো ফোনে এই প্রতিনিধিকে জানান, মামলা চালানোর পক্ষে আমি কখনও ছিলাম না, আজও চালাতে চাই না, সামান্য ১৩ শতক বসত ভিটায় অনেক গুলো শরীক একেকজনের মতামত একেক রকম যার ফলে আজও মামলাটি আদালতে ঝুলে আছে।
মামলার বিবাদিপক্ষের আইনজীবী এড. বিভাষ চন্দ্র বিশ্বাস রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আলোচিত মামলাটির যথেষ্ট মেরিট থাকা সত্ত্বেও রায় অনুকুলে না আসা দুঃখজনক। আমরা ন্যায় বিচারের স্বার্থে সুপ্রিম কোর্টে ‘‘লিভ টু আপিল’’ আবেদন করেছি। বর্তমান শুনানীর অপেক্ষাই আছে। আশা করছি ন্যায়বিচার পাবো।’
এদিকে মামলার বাদি মো. তরিকুল ইসলাম তারিক বিষয়টি সমাধানে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
খুলনা গেজেট/এনএম