মূখ্য নির্বাহী পদ নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যেই ভ্যাট গোয়েন্দার মামলার মুখে পড়ল ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স। বেসরকারি বীমা প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ৩৫ কোটি ১৭ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পাওয়ায় ভ্যাট আইনে মামলাটি করা হয়েছে।
মামলাটির সত্যতা নিশ্চিত করে নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্ততরের (মূল্য সংযোজন কর) মহাপরিচালক ড. মইনুল খান জানান, ভ্যাট ফাঁকির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকায় ভ্যাট গোয়েন্দার সহকারী পরিচালক সায়মা পারভীনের নেতৃত্বে একটি দল বীমা কোম্পানিটির ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত লেনদেনের তদন্ত করে। ভ্যাট গোয়েন্দার দল তদন্তের স্বার্থে দলিলপত্র চেয়ে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে তলব করে।
প্রতিষ্ঠানটির দেয়া বার্ষিক সিএ রিপোর্ট, প্রতিবেদন, দাখিলপত্র (মূসক-১৯) এবং বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক জমা করা ট্রেজারি চালানের কপি ও অন্যান্য দলিল থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের আড়াআড়ি যাচাই করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি স্বাস্থ্য বীমাখাতে ভ্যাট হিসেবে ৪০ লাখ ৫৫ হাজার ৭৩ টাকা পরিশোধ করেছে। কিন্তু তাদের প্রদেয় ভ্যাটের পরিমাণ ছিল ১০ কোটি ২১ লাখ ৩৭ হাজার ৪১১ টাকা। এক্ষেত্রে তারা প্রকৃত বিক্রয় তথ্য গোপন করেছে।
অপরিশোধিত ভ্যাট বাবদ ৯ কোটি ৮০ লাখ ৮২ হাজার ৩৩৯ টাকার ফাঁকির বিষয়টি সামনে আসার পর এখন ডেল্টা লাইফকে ভ্যাট আইন অনুযায়ী মাসিক ২ শতাংশ হারে ১১ কোটি ৩০ লাখ ৪০ হাজার ৭৭৮ টাকা সুদ দিতে হবে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরীক্ষা মেয়াদে সিএ ফার্মের রিপোর্ট অনুযায়ী উৎসে ৬ কোটি ৩৪ লাখ ৭ হাজার ৮০৩ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু তাদের প্রদেয় ভ্যাটের পরিমাণ ছিল ১১ কোটি ৩ লাখ ১৩ হাজার ২৪৯ টাকা।
এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির অপরিশোধিত ভ্যাট বাবদ ৪ কোটি ৬৯ লাখ ৫ হাজার ৪৪৬ টাকার ফাঁকি ধরা পড়ে। উৎসে কর্তনের ওপর প্রযোজ্য এই ফাঁকি দেয়া ভ্যাটের ওপর ভ্যাট আইন অনুসারে মাসিক ২ শতাংশ হারে ৫ কোটি ৫৭ লাখ ৭৫ হাজার ১৬৯ টাকা সুদ টাকা আদায়যোগ্য।
অন্যদিকে তদন্তের সময়কালে প্রতিষ্ঠানটি স্থান ও স্থাপনার ভাড়ার বিপরীতে ১ কোটি ৪৬ লাখ ১৪ হাজার ৯৮০ টাকা পরিশোধ করেছে। এক্ষেত্রে তাদের প্রদেয় ভ্যাটের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ২০ লাখ ৫৫ হাজার ১০১ টাকা। তারা ফাঁকি দিয়েছে ১ কোটি ৭৪ লাখ ৪০ হাজার ১২০ টাকা। ভ্যাট আইন অনুযায়ী এই ফাঁকির ওপরেও মাসিক ২ শতাংশ হারে ২ কোটি ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৮৮১ টাকা সুদ প্রযোজ্য।
এই তদন্ত মেয়াদে প্রতিষ্ঠানটির সর্বমোট অপরিশোধিত ভ্যাটের পরিমাণ ১৬ কোটি ২৪ লাখ ২৭ হাজার ৯০৫ টাকা এবং সুদ বাবদ ১৮ কোটি ৯২ লাখ ৬২ হাজার ৮২৮ টাকাসহ ৩৫ কোটি ১৬ লাখ ৯০ হাজার ৭৩৩ টাকা পরিহারের তথ্য উদঘাটিত হয়।
মইনুল খান বলেন, ডেল্টা লাইফ সরকারের ভ্যাট ফাঁকির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরনের জালিয়াতি ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। ভ্যাট আইন অনুযায়ী যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাদের বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তদন্তে উদঘাটিত পরিহার করা ভ্যাট আদায়ে পরবর্তী আইনি কার্যক্রম গ্রহণের জন্য প্রতিবেদনটি ভ্যাট কমিশনারেট ঢাকা উত্তরে পাঠানো হবে।’
আটকে গেল আদিবা রহমানের নিয়োগ অনুমোদন
এদিকে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমানের মেয়ে আদিবা রহমান পুনরায় প্রতিষ্ঠানটিতে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ পাচ্ছেন না। গ্রাহকদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগের মুখে থাকা ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।
গতকাল আইডিআরএর সাবেক সদস্য সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লাকে প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসক হিসেবে চার মাসের জন্য এ নিয়োগ দেয়া হয়। তাকে নিয়োগ দিয়ে এক চিঠিতে আইডিআরএ বলেছে, ‘বীমা আইন ২০১০ এর ৯৬ ধারার (১) উপধারা অনুযায়ী প্রশাসক হিসেবে চূড়ান্তভাবে দায়িত্ব গ্রহণের ৪ মাসের মধ্যে কর্তৃপক্ষের কাছে একটি প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।’
বীমা আইন ২০১০ এর ধারা ৯৫(৩) এর আলোকে নতুন পলিসি ইস্যু আগের মতো অব্যাহত রাখা এবং কোম্পানির ব্যবসা ও অন্যান্য কার্যক্রম যথারীতি পরিচালনা করতেও বলা হয়েছে এ সংক্রান্ত নির্দেশনায়।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, কোম্পানির প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মো. শাখাওয়াত নবী, (অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব) এবং মো. রফিকুল ইসলামকে (অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব) পরামর্শক (কনসালটেন্ট) হিসেবে শিগগিরই নিয়োগ দিয়ে কোম্পানির প্রশাসনিক কার্যক্রম সুচারুভাবে পরিচালনা করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
এতে বলা হয়েছে, আপনার (সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লা) মাসিক সম্মানী সর্বমোট ৪ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হলো। তবে উৎসব ভাতা (যদি থাকে) মোট সম্মানীর ৬০ শতাংশ পাবেন। শিগগিরই সুপ্রতিষ্ঠিত কোনো দেশি বা বিদেশি অডিট ফার্ম দিয়ে কোম্পানির অডিট সম্পন্ন করতেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে চিঠিতে। পাশাপাশি ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে যেকোনো সময়, যেকোনো বিষয়ে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার জন্য আবেদন করতে বলা হয়েছে।
বীমা আইনের ৯৫ ধারার শর্ত মেনেই তাকে ডেল্টা লাইফের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে সুলতান-উল আবেদীন মোল্লা সাংবাদিকদের বলেন, ‘সরকার চার মাসের জন্য আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে। কোম্পানিটি দু’টি অডিট ফার্মকে কোনো সহযোগিতা করেনি, এটি গ্রাহক স্বার্থের পরিপন্থী।’
তিনি আরো বলেন, ‘প্রশাসক নিয়োগ করা হলেও কোম্পানির কার্যক্রম আগের মতোই পরিচালিত হবে। এতে শেয়ারহোল্ডার ও গ্রাহকরা কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। প্রশাসক নিয়োগের বিষয়টি নতুন কিছু নয়। বীমাখাতের বাইরেও অনেক খাতে সরকার প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে আসছে। পলিসিহোল্ডারের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যই সরকার এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে।’
বিগত কয়েক বছর ধরেই ডেল্টা লাইফের প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি অনিয়ম ও দুর্নীতি চলে আসছিল। এ জন্য ২০১৯ সাল থেকে কোম্পানিটিতে দু’টি নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। এই নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দু’টিকে কোন রকম সহযোগিতা করেনি ডেল্টা লাইফ।
দায়িত্ব পেয়ে গতকালই ডেল্টা লাইফের কার্যালয়ে যান সুলতান-উল আবেদিন মোল্লা। এ সময় তিনি কোম্পানিটির সাবেক পরিচালক মঞ্জুরুর রহমান ও সাবেক মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আদিবা রহমানের কার্যালয়ে তাদের সাথে সাক্ষাত করেন। পরে তিনি কোম্পনিটির বিভাগীয় প্রধানদের সাথে বৈঠক করেন। এসময় তার সাথে উপস্থিত ছিলেন আইডডিআরএর পরিচালক (উপ-সচিব) মো. শাহ আলম।
উল্লেখ্য, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আদিবা রহমানের পুনরায় মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের আবেদন নাকচ করে আইডিআরএ। বীমা গ্রাহকদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কায় তার আবেদন নবায়ন করা হয়নি বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএর চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ তুলেছে বীমা কোম্পানিটি। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান এবং তার মেয়ে ও কোম্পানিটির সাবেক মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আদিবা রহমানের বিরুদ্ধে ২৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে মানহানি মামলা করেছেন বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন।
খুলনা গেজেট/কেএম