আবারও এসেছে বাঙালির ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির উৎসবের বাংলা বর্ষবরণ। আবারও সেই দুঃস্মৃতি। ২৩ বছর আগে রাজধানীর রমনা বটমূলে পুতে রাখা বোমা বিস্ফারণের ভয়াবহতা ও হতাহতের ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা দেশ। নির্মম ও মর্মান্তিক এই ঘটনার পর পার হয়েছে দুই দশকের বেশি সময়। বিস্ফোরণে হত্যার অভিযোগের মামলা প্রায় ১০ বছর আগে বিচারিক আদালতের রায়ে ফাঁসির সাজা হয়েছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হুজি’র (হরকাতুল জিহাদ) ৮ জঙ্গির। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারের অপেক্ষা এখনও কাটেনি।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের মামলা) এখনো হাইকোর্টে বিচারাধীন। অন্যদিকে একই ঘটনায় করা বিস্ফোরক আইনের মামলাটি এখনো বিচারিক আদালতের গন্ডি পেরোইনি। এই মামলাটি রয়েছে আাসমিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের পর্যায়ে। এরপর যুক্তিতর্কের শুনানি নিয়ে রায়ের পর্যায়ে আসবে। এমন পরিস্থিতিতে প্রায় দুই বছর ধরে বিস্ফোরক মামলায় শুনানি একপ্রকার বন্ধ রয়েছে।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ এম আমিন উদ্দিন সম্প্রতি বলেছেন, হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের ডেথ রেফারেন্সের ওপর শিগগির শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে।
২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল সকালে রমনা বটমূলে ছায়ানটের উদ্যোগে বর্ষবরণের অনুষ্টানে শত শত মানুষের আনন্দ উদযাপনের মধ্যে ঘটে ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণ। জঙ্গিদের আগে থেকে পুতে রাখা বোমার বিস্ফোরণে মারা যান ১০ জন। কমবেশি আহত হন শতাধিকের বেশি মানুষ। পরে তদন্তে জানা যায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হুজি (হরকাতুল জিহাদ) এ ঘটনা ঘটিয়েছে এবং ঘটনার মূল হোতা হুজির শীর্ষ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান (অন্য মামলা ফাঁসির সাজা কার্যকর)। ঘটনার পর এই জঙ্গি সংগঠনের ১৪ জনকে আসামি করে রমনা থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি পৃথক মামলা হয়। তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের নভেম্বরে হত্যা মামলায় অভিযোগপত্র দাখিলের পর ২০০৯ সালের ১৬ এপ্রিল অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয় সংশ্লিষ্ট আদালত।
২০১৪ সালের ২৩ জুন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের রায়ে মুফতি হান্নানসহ আটজনকে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ হয়। এছাড়া ছয়জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাবাসের আদেশ।
ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত অপর আসামিরা হলেন— মাওলানা আকবর হোসেন, মুফতি আব্দুল হাই, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মুফতি শফিকুর রহমান, মাওলানা তাজউদ্দিন, আরিফ হোসেন ওরফে সুমন।
তবে, সর্বোচ্চ দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে আব্দুল হাই, জাহাঙ্গীর আলম বদর, সেলিম হাওলাদার ও তাজউদ্দিন এখনো পলাতক। আর আকবর হোসেন, আবু বকর ও শফিকুর রহমান এখন কারাগারে। অন্য মামলায় মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকর করার ফলে এ মামলায় এখন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ৭ জন।
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তরা হলেন— হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, মাওলানা আব্দুর রউফ, মাওলানা সাব্বির ওরফে আবুল হাসান সাব্বির, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, শাহাদাত উল্লাহ ওরফে জুয়েল। রায়ের পর একই বছরের ২৬ জুন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ডেথ রেফারেন্স আসে হাইকোর্টে। আলোচিত এ মামলাটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির অংশ হিসেবে ২০১৫ সালের অক্টোবরে এই মামলার পেপারবুক (বিচারিক আদালতের রায়সহ যাবতীয় নথি) প্রস্তুত হয়। কিন্তু অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকলেও মামলার শুনানিতে গতি আসেনি।
রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের তথ্য মতে, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের শুনানি শুরু হয়। পরে ওই বেঞ্চের এখতিয়ার পরিবর্তন হলে শুনানি সম্ভব হয়নি। এরপর ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে একাধিক বেঞ্চে শুনানির তারিখ হলেও বিচারকদের এখতিয়ার পরিবর্তনে শুনানি শুরু করা যায়নি। তবে, আসামিপক্ষের আইনজীবীদের অনুযোগ, বার বার তারিখ নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ শুধু সময়ের আবেদন করেছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, করোনা সংক্রমণ, বিচারকের এখতিয়ার পরিবর্তনের কারণে শুনানি সম্ভব হয়নি।
আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘২০১৪ সালের ডেথ রেফারেন্স মামলা এখনো বিচারাধীন। প্রায় ১০ বছর ধরে আসামিরা কনডেম সেলে আছেন। কিন্তু বিচার এখনো নিস্পত্তি হচ্ছে না। এ মামলায় বছরের পর বছর রাষ্ট্রপক্ষ শুধু সময় নিয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা মামলাটি দ্রুত নিস্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘বিচারকের এখতিয়ার পরিবর্তন, করোনা সংক্রমণে বিচারকাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো যৌক্তিক কারণেই এতদিন শুনানি হয়নি। তবে, শিগগির আমরা মামলাটির শুনানির বিষয়ে উদ্যোগ নেব।’
খুলনা গেজেট/এইচ