বিনয় সরকার। মুক্তিযুদ্ধকালীন খুলনা জেলা ছাত্রলীগের কোষাধ্যক্ষ। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। বটিয়াঘাটা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কামান্ডার। তিনি বটিয়াঘাটা উপজেলার বারোআড়িয়া যুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধাদের অধিনায়ক। সেদিনের যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন। বারোআড়িয়া ছাড়াও পাইকগাছা, কপিলমুনি ও স্বাধীনতার ঊষালগ্নে গল্লামারী যুদ্ধে অংশ নেন।
বারোআড়িয়া যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে তিনি বলেন, পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের পুঁটিমারী গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। বৃহত্তর খুলনা মুজিববাহিনীর প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকুর পরামর্শে বারোআড়িয়ায় রাজাকারদের ক্যাম্প দখলের জন্য মানসিকভাবে আমরা প্রস্তুতি নেই। মুজিববাহিনীর প্রধানের কাছে খবর আসে বারোআড়িয়ায় রাজাকাররা সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন করছে। এ যুদ্ধের জন্য তাকে মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক নির্বাচন করা হয়। ২৮ নভেম্বর রাতে কনকনে শীতের মধ্যদিয়ে নৌকাযোগে পুঁটিমারী ক্যাম্প থেকে তার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি বারোআড়িয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের এ দলের কাছে একটি করে আরসিএল, এলএমজি, এসএমজি এবং বেশ কয়েকটি এসএলআর ও থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ছিল। গভীর রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি বারোআড়িয়া বাজারের পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাস্তার ওপর এসে হাজির হয়। মনি গোলদারের পরিত্যক্ত বাড়িতে রাজাকাররা তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। অধিনায়কের নির্দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুর রহমান রাজাকার ক্যাম্পে যেয়ে বিস্ফোরক দ্রব্য লাগিয়ে আসে। অল্প সময়ের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু আশানুরূপ ফল হয়নি।
অধিনায়ক স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে আরও বলেন, বেশ কয়েকজন রাজাকার আহত হলেও তারা মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে গুলি ছুঁড়তে থাকে। এ যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা জ্যোতিষ চন্দ্র মন্ডল ও মোল্লা আব্দুল আজিজ শহীদ হন। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অধিনায়ক একাই দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ করেন। পরে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে যুদ্ধে অংশ নেয়। যুদ্ধ রাত ১১টা থেকে শুরু হয়ে পরদিন দুপুর ২টা পর্যন্ত একটানা যুদ্ধ হয়। বেলা আনুমানিক ২টা নাগাদ রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করেন। এ ক্যাম্পের উল্লেখযোগ্য রাজাকাররা হচ্ছে, বারোআড়িয়া গ্রামের হাতেম আলী ও মোজাহার। রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে ক্যাম্পটি দখল করে নেয়। এখানেই ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। এই ক্যাম্প থেকে লঞ্চযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় একটি অংশ চক্রাখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ক্যাম্পে এসে উপস্থিত হয়। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান মুক্ত হওয়ার পর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা জয়ের উদ্দেশ্যে চক্রাখালী ক্যাম্পে জড়ো হয়। চক্রাখালী ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গল্লামারীস্থ রেডিও সেন্টারের সেনা ছাউনীতে আক্রমণ করে। ১৪-১৭ ডিসেম্বর গল্লামারীতে যুদ্ধ হয়। গল্লামারীর পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করলে বিজয়ের বেশে মুক্তিযোদ্ধারা পায়ে হেঁটে সার্কিট হাউজ ময়দানে এসে হাজির হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে হাজারও শহরবাসী শ্লোগান দেয় ‘জয় বাংলা’।
খুলনা গেজেট/এএ