বিশ্ব বাজারে দরপতনের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে দেশের সাদা সোনা খ্যাত রপ্তানিমুখী হিমায়িত চিংড়ি শিল্প। ফলে দুর্দিন কাটছে না সাতক্ষীরার চিংড়ি চাষী ও ব্যবসায়িদের। একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি মহামারি করোনায় বিশ্ববাজারে চিংড়ির চাহিদা কমে যাওয়ায় দেশের বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন চাষিরা। এতে করে উৎপাদস খরচের সাথে বিক্রি মূল্যের তাল মিলাতে না পেরে সর্বশান্ত হতে বসেছেন চাষীরা।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে সাতক্ষীরায় মাছের ক্ষতি হয় ১৭৬ কোটি টাকা। এরপর ২০২১ সালের ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে মাছের ক্ষতি হয় ১৬ কোটি টাকা। সবশেষ গত ২৭ জুলাই অতিবৃষ্টিতে ক্ষতি হয় ৫৩ কোটি টাকার মাছ।
সূত্রমতে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ঘূর্ণিঝড় আম্পানে। এ ঝড়ে ১০ হাজার ২৫৭ টি মাছের ঘের সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে করে ১৭৬ কোটি টাকার চিংড়ি ও সাদা মাছ নষ্ট হয়ে যায়।
মৎস্য বিভাগ জানায়, চিংড়ি শিল্প থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হয়। করোনাকালে বিদেশে চিংড়ি রপ্তানি কমে যাওয়ায় আয়ের সেই খাতটিও প্রায় বন্ধ হতে বসেছে। এতে করে লোকসানের মুখে পড়ে চিংড়ি চাষীরা।
সূত্র আরো জানায়, সাতক্ষীরা জেলায় ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরে দেড় লাখ টনের বেশি রপ্তানিজাত চিংড়ি উৎপাদন হয়েছিল। যার রপ্তানি মূল্য সাড়ে ৭হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে করোনা মহামারী ও বিশ্ব বাজারে দরপতনের পপাশাপাশি মানসম্মত না হওয়ায় গত দুই বছরে রপ্তানিযোগ্য এসব চিংড়ির বড় অংশই দেশীয় বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এতে ক্ষতিগস্ত হচ্ছেন চাষীরা।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, সাতক্ষীরা জেলায় বছরে প্রায় ৬০ হাজার নিবন্ধিত ঘেরে চিংড়ি চাষ করা হয়। জেলার এসব ঘেরে গত পাঁচ বছরে রপ্তানিজাত চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে এক লাখ ৫২ হাজার ১৪৬ টন। এর মধ্যে বাগদা চিংড়ি এক লাখ ১৮ হাজার ৩০৮ টন। গলদা চিংড়ির পরিমাণ ৩৩ হাজার ৮৩৭ টনের মতো। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ২৫ হাজার ৩৫৪ টন বাগদা ও ৬ হাজার ৩৪ টন গলদা চিংড়ি। এছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৬ হাজার ৪৮৫ টন বাগদা ও ৬ হাজার ১০৬ টন গলদা, ২০১৭-১৮ বাগদা ২০ হাজার ৯৪১ টন ও গলদা ৬ হাজার ৫২৫ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাগদা ২১ হাজার ৪৪১ টন ও গলদা ৬ হাজার ৫৪২ টন এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৪ হাজার ৮৭ টন বাগদা ও ৮ হাজার ৬৩০ টনের মতো চিংড়ি উৎপাদন হয়। উৎপাদিত এসব চিংড়ির রপ্তানিমূল্য ৭ হাজার ৬০৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
সাতক্ষীরা আশাশুনি উপজেলার বিছট এলাকার চিংড়ি উৎপাদনকারী নুরুল আলম বলেন, প্রায় দেড় যুগ ধরে চিংড়ি চাষ করে আসছি। প্রায় ২৮০ বিঘা জমিতে মাছের ঘের রয়েছে তার। এসব ঘেরে উৎপাদিত চিংড়ি ৮শ’টাকা থেকে এক হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি। পোনার মূল্য একই থাকলেও এখন এক কেজি চিংড়ি সর্বোচ্চ ৬শ’ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। ডিপো মালিকরা মাছ কেনা কমিয়ে দেয়ায় বাধ্য হয়ে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে। যে কারণে উৎপদন খরচের সাথে বিক্রি মূল্যের তাল মেলানো যাচ্ছে না। ফলে গত দুই বছর ধরে লোকসান গুনতে হচ্ছে। এঅবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে চিংড়ি চাষ বন্ধ করে দেয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবে না বলে জানান তিনি।
একই কথা বলেন, সদর উপজেলার বাটকেখালী এলাকার সাইফুল ইসলাম বাবু।
তিনি বলেন, বিগত ৫/৬ বছরের ন্যায় চলতি মৌসুমেও ৬৫ বিঘা জমির একটি ঘেরে চিংড়ি চাষ করেছি। তবে দুই-তিন বছর চিংড়ির ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারি করোনা ছাড়াও চিংড়িতে ভাইরাস রোগের কারণে মাঝে মধ্যে মড়ক লাগে। এতে চিংড়ি চাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে। ঘেরের মাছ স্থানীয় খোলা বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে। বিশ্ববাজারে চিংড়ি বিক্রি না বাড়লে দেশের আভ্যন্তরীন বাজারে বিক্রি করে চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
রপ্তানিজাত চিংড়িসহ অন্যান্য মাছ উৎপাদনে সাতক্ষীরা খুবই সম্ভাবনাময় বলে মনে করেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আনিছুর রহমান। তিনি বলেন, এখানকার মাটি, পানি ও আবহাওয়া সব ধরণের মাছ চাষের উপযোগী। প্রতি বছর এ জেলায় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার চিংড়ি অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি রপ্তানি করা হয়। এছাড়া সাদা মাছও ব্যাপকভাবে উৎপাদন হচ্ছে। এক লাখ টনের ওপরে সাদা মাছ উৎপাদন হয়, যা এ জেলার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অ লে সরবরাহ করা হয়। মাছ চাষের সঙ্গে সাতক্ষীরার সাতটি উপজেলায় প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ সরাসরি সম্পৃক্ত।
সূতমতে, আশির দশক থেকে মূলত সাতক্ষীরায় বাণিজ্যিকভাবে চিংড়ি উৎপাদন শুরু হয়। দেশের যে কয়টি জেলায় রপ্তানিজাত চিংড়ি উৎপাদন হয়, তার মধ্যে অন্যতম সাতক্ষীরা। প্রতি বছর সাতক্ষীরা থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাগদা ও গলদা চিংড়ি রপ্তানি হয়, যা দেশের অর্থনীতিতে একটি বড় ভূমিকা রাখছে। তবে জেলার অনেক চাষী অপরিকল্পিতভাবে চিংড়ি চাষ করছেন। ফলে একদিকে যেমন উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। এতে পরিবেশ ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
সাতক্ষীরার চিংড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান দীপা সি ফুড ইন্টারন্যাশনাল এর ব্যবস্থ্পানা পরিচালক দীনবন্ধু মিত্র বলেন, আমেরিকা, জাপান সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আমি চিংড়ি রপ্তানি করে থাকি। কিন্তু করোনা মহামারির পাশাপাশি ইউক্রের ও রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে রাজনৈতিক অস্থিতিশিলতার কারণে ইউরোপ ও জাপানে মাছ রপ্তানি কমে গেছে। এসময় আমেরিকা কিছু মাছ কিনলেও পরিমানে খুবই কম।
এছাড়া বিশ্ব বাজারে দরপতনের কারণে প্রতি কেজি চিংড়ির দাম প্রায় ৩শ’ টাকা কমে গেছে। যেকারণে চিংড়ি রপ্তানি করে মোটা অংকের লোকসানের মুখে পড়ছেন ব্যবসায়িরা। এসব কারণে অনেক রপ্তানি কারক প্রতিষ্ঠান মাছ কিনতে সাহস পাচ্ছেন না।
তিনি আরো বলেন, আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে ব্যাপকভাবে ভেনামী জাতের চিংড়ি চাষ হচ্ছে। এই জাতের চিংড়ি প্রতি কেজি দাম প্রায় ৪শ’টাকা। দাম কম থাকায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভেনামী চিংড়ির চাহিদাও বেশি। যেকারণে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না আমাদের দেশে উৎপাদিত চিংড়ি। ফলে ব্যবসায়িকভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এছাড়া কয়েক বছর ধরে মানসম্মত চিংড়ি উৎপাদন না হওয়ায় বিদেশে রপ্তানি কম হচ্ছে। ফলে বিপুল পরিমাণ চিংড়ি স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষীরা।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, যেকোনো মাছ উৎপাদনে সাতক্ষীরার সুনাম রয়েছে। সাতক্ষীরা খুবই সম্ভাবনাময় একটি জেলা। সাদা মাছের পাশাপাশি বছরে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চিংড়ি বিদেশে রপ্তানি হয়। মাছচাষীরা যাতে আগামীতে আরও বেশি উৎপাদন করতে পারেন, সেজন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে। বিশেষ করে যারা প্রান্তিক পর্যায়ের মৎস্যচাষী, তাদের সরকারের প্রণোদনা পাওয়ার ক্ষেত্রেও সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
খুলনা গেজেট/এমএম