আপিল বিভাগের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশের পরও আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। এতদিন এই আন্দোলন নিয়ে সরকার নমনীয় থাকলেও এবার হার্ডলাইনে যাচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ। এতে বেশকয়েকজন শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক আহত হয়েছেন। আন্দোলনকারীরা সড়ক অবরোধ করলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
এদিকে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা জনজীবনকে জিম্মি করে, আদালতের প্রতি কোনো ধরনের সম্মান প্রদর্শন না করে তথাকথিত বাংলা ব্লকেডের কর্মসূচি দিয়ে মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত করার চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেছেন ওবায়দুল কাদের। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে উল্লেখ করে তাদের অযথা রাস্তায় ভিড় না করতে এবং নিজ নিজ শিক্ষাঙ্গনে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। আন্দোলনকারীদের রাস্তা অবরোধ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি না করে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন।
অন্যদিকে, সুপ্রিম কোর্ট স্থিতাবস্থা দেওয়ার পর কোটা আন্দোলনের আর কোনো যৌক্তিকতা নেই জানিয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার কেএইচ মাহিদ উদ্দিন বলেছেন, আন্দোলনকারীরা সড়ক অবরোধ করলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সরকারি চাকরির সব গ্রেডে অযৌক্তিক এবং বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ন্যূনতম মাত্রায় (সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ) এনে সংসদে আইন পাসের দাবিতে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করছেন কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা। সারা দেশেই এই আন্দোলন চলছে। গতকাল বিকেলে কেন্দ্রীয়ভাবে রাজধানীর শাহবাগ অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। এরপর রাত ৯টার দিকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেন, সংসদ থেকে কোটার বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসার আগ পর্যন্ত আমরা রাজপথ ছাড়ব না। শুক্রবার (আজ) বিকেল ৪টায় সারা দেশে একদফার সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর বিনা উসকানিতে হামলা ও এর সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে।
গতকাল কর্মসূচি চলাকালে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ। এতে চার সাংবাদিকসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, বিকেল সোয়া ৩টায় কুবি শিক্ষার্থীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করার উদ্দেশ্যে বের হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আনসার ক্যাম্প সংলগ্ন স্থানে বাধা দেয় পুলিশ। এতে প্রথমে ধস্তাধস্তি হয়। পরবর্তী সময়ে আবাসিক হল ও মেসের প্রায় সাত-আটশ শিক্ষার্থী এসে যুক্ত হয়ে পুলিশের বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হতে চাইলে পুলিশ প্রথমে লাঠিচার্জ করে। এরপর কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলির পাশাপাশি টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। এ সময় শিক্ষার্থীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ও পাথর নিক্ষেপ করে। পুলিশের লাঠিচার্জে আমাদের সময়ের সংবাদদাতা অনন মজুমদার, ইত্তেফাকের সংবাদদাতা মানছুর আলম অন্তর, চ্যানেল আইয়ের সৌরভ সিদ্দিকীসহ অন্তত ২০ জন আহত হন। তাদের অ্যাম্বুলেন্সে করে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পরও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা মহাসড়কে টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবাদ জানান। কুবি উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল মঈন সেখানে গেলে শিক্ষার্থীরা তার ওপর জুতা ও পানির বোতল ছুড়ে মারেন। ফলে তিনি তৎক্ষণাৎ ওই স্থান ত্যাগ করেন।
রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) আন্দোলরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে ৮ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। বিকেলে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ফটকের সামনে এলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ করলে সংঘর্ষ হয়। এরপর পুলিশি বাধা অতিক্রম করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংলগ্ন সড়কে অবস্থান করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। পরে তারা মিরপুর-ফার্মগেট সড়ক অবরোধ করে অবস্থান ও বিক্ষোভ মিছিল করেন।
চট্টগ্রামে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে পুলিশি বাধার মুখোমুখি পড়তে হয়েছে আন্দোলনকারীদের। এ সময় আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ। এতে আহত হন বেশ কয়েকজন। তবু থামেননি আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনকারীর একটি অংশ নগরের দুই নম্বর গেটে ব্যস্ত সড়কে অবস্থান নেয়। কোটা বাতিলের একদফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বেন না বলে হুঁশিয়ারি দেন শিক্ষার্থীরা। আমরণ অনশনের ঘোষণাও দেন।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) মিছিল বের করার সময় শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। বিকেল সাড়ে ৪টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেটের সামনে এ ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল বড়ুয়া বলেন, সেটি (হাতাহাতি) প্রক্টরিয়াল বডির সঙ্গে কথা বলার সময় হয়েছে। প্রক্টর শরিফুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে রাজশাহীতে রেললাইন অবরোধ করেছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেশনবাজার সংলগ্ন ঢাকা-রাজশাহী রেললাইন অবরোধ করেন তারা। রাত ৯টার দিকে অবরোধ ছাড়েন তারা।
পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করেছেন। পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের হাতাহাতিতে আহত হয়েছেন দুই শিক্ষার্থী। বিকেল ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিল করে প্রধান ফটকে এলে পুলিশ আন্দোলনকারীদের বাধা দেয়। পরে শিক্ষার্থীরা বাধা উপেক্ষা করে সড়ক অবরোধ করেন।
পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা। বিকেল ৪টার দিকে একটি মিছিল নিয়ে মহাসড়কে অবস্থান নেন তারা। বিকেলে কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষার্থীরা। এর আগে দুপুর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা মহাসড়কে আসার সময় প্রধান ফটকে পুলিশি বাধার মুখে পড়েন। পরে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করেই মহাসড়ক বিক্ষোভ মিছিল করেন তারা।
খুলনা গেজেট/এইচ