খুলনা, বাংলাদেশ | ২৬ আশ্বিন, ১৪৩১ | ১১ অক্টোবর, ২০২৪

Breaking News

  বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে তিন ধাপ পিছিয়ে ৮৪তম বাংলাদেশ
  দীপ্ত টিভির তামিম হত্যা: ৫ আসামি ৪ দিনের রিমান্ডে

হাট‌খোলাতেই তের বছর কেটে গেছে নীলকান্তের

নিতিশ সানা, কয়রা

সাড়ে ছয় বিঘা ধানি জমি এবং এক বিঘার বসতভিটা ছিল নীলকান্তের। বছরে দু’বার ফসল ফলতো সেই জমিতে। ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে সুখেই ছিলেন তিনি। কিন্তু সেটা তের বছর আগের কথা। এখন তিনি হাটখোলার খুপরি ঘরের বাসিন্দা। প্রলয়ঙ্কারি ঘূর্ণিঝড় আইলায় নিঃস্ব হয়ে আশ্রয় নেওয়ার পর তের বছর কেটে গেছে সেখানেই।

নীলকান্ত বলেন, ‘ঘরবাড়ি, গরু, ছাগল, সহায়-সম্পদ সবকিছুই ভাসায়ে নেয় কপোতাক্ষের ফুসে ওঠা জল। আর ভাঙনে গাঙের প্যাটে যায় ফসলি জমির সবটাই। এখন গতর খাটায়ে চলতি হয়। তাই আর ভাল ঘর তুলতি পারিনি।’

নীলকান্তের মতো খুলনার কয়রা উপজেলার কাশিরহাটখোলাটি এখন গ্রামের ভূমিহীন মানুষের দখলে। হাটের সারি সারি খুপরি দোকানগুলোতে পরিবার নিয়ে বাস করছেন গ্রামের ভূমিহীন ২৭টি পরিবার। বাকি পরিবারগুলোর আশ্রয় হয়েছে বাঁধের উপর।

গ্রামবাসি জানান, ২০০৯ সালের ২৫ মে’র জলোচ্ছ্বাসের পর থেকে গ্রামের জীবনচিত্র বদলাতে শুরু করে। সেদিনের সেই ৭ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস নিমেষেই তছনছ করে দেয় সবকিছুই। ঘরবাড়ি, গবাদি পশু, সহায়-সম্পদ ভেসে যায় মানুষের। জমিতে লোনা বসে যাওয়ায় আইলার পরে কয়েক বছর ফসল উৎপাদন করতে পারেনি কেউ। সেই থেকে একের পর এক গ্রাম ছাড়তে শুরু করে মানুষ। গ্রামের ৫শ’ পরিবারের মধ্যে বর্তমানে ৭০-৮০টি রয়েছে সেখানে। বাকি পরিবারগুলো এক প্রকার নিঃস্ব হয়ে চলে গেছে অন্যত্র। গত সপ্তাহেও দু’টি পরিবার গ্রাম ছেড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

গ্রামের বয়োবৃদ্ধ নুরালি শেখ বলছিলেন, কেবল আইলা যে তাদের নিঃস্ব করেছে তা নয়। আইলার পর কয়েকটি বড় দুর্যোগ মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হয়েছে তাদের। বুলবুল, ফণি, আম্পান এবং সর্বশেষ ২০২১ সালে ২৫ মে ইয়াসের ছোবলে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে এলাকা। এসব দুর্যোগ নতুন দুর্ভোগের মুখোমুখি করেছে মানুষকে। অনেকেই ত্যাক্ত হয়ে এলাকা ছেড়েছে। কিন্তু তার মতো অনেকেই রয়ে গেছেন। কারণ ইচ্ছা থাকলেও যাওয়ার সক্ষমতা নেই তাদের।

‘গ্রামের কার্তিক মন্ডল তার ৫ সন্তান, স্ত্রী ও বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে গত দুই বছর বাঁধের উপর খুপরি তুলে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, আইলা আমার ঘর ভাসিয়ে নিলেও ফসলি জমি নিতি পারিনি। সেখানেই ঘর তুলি বাস করতাম। কিন্তু ২০২০ সালের আম্পান আমাকে নিঃস্ব করে ছেড়েছে। এখন ভগবানের উপর ভরসা করে টিকে আছি। গাঙে মাছ ধরি আর খাই। তার মতে আইলার পরে আম্পানেই এলাকার মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছে।’

গ্রামের কার্তিক সরকার বলেন, এক সময় এই হাটখোলাটি ছিল জমজমাট। দুর দুরান্তের হাটুরিয়ারা আসতো পসরা নিয়ে। সারি সারি নৌকা বাঁধা থাকতো ঘাটে। হাটুরিয়াদের হাঁকডাকে মুখরিত থাকতো এলাকা। এখন তা অতীত। আইলার পর থেকে হাটখোলাটি সম্পূর্ণ আমার মতো গৃহহীন মানুষের দখলে। এখন আর হাট বসে না।

একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে গৃহহীন হয়ে উপকূলীয় অসংখ্য মানুষ। কেউ খুলনা নগরীতে, কেউ রাজধানীতে আবার কেউ পার্বত্য অঞ্চল ও দেশান্ত‌রিত হ‌তে বাধ্য হয়েছে। পেশা পরিবর্তন ও পেশা হারিয়েছে বহু মানুষ। আর যারা এলাকায় রয়েছে তাদের টিকে থাকতে হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই করে। ঘুর্ণিঝড় আইলায় ১৩ বছরেও ভাগ্য বদলায়নি উপকূলীয় কয়রা উপজেলার মানুষের।

স্থানীয় উত্তর বেদকাশি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সরদার নুরুল ইসলাম বলেন, আইলায় এলাকার মানুষের ক্ষত হয়েছে। সে ক্ষত না শুকাতেই একের পর দুর্যোগের হানা, নিঃস্ব করে ফেলেছে মানুষকে। অসহায় মানুষ যে যেভাবে পারছে আশ্রয় নিয়েছে। চাইলেও তাদের সেখান থেকে সরানো সম্ভব হচ্ছে না। সবচেয়ে বেশি অসুবিধা ফসলি জমিতে লোনা বসে যাওয়ায়। সেখানে বছরের পর বছর ফসল ফলানো সম্ভব না হওয়ায় অভাবের তাড়নায় মানুষ বাইরে চলে যাচ্ছে।

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, এ উপজেলাটি ভৌগলিক কারণে দুর্যোগ কবলিত। সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাটি তিন দিক থেকে নদী বেষ্টিত। যে কারণে ছোটখাটো দুর্যোগেও প্লাবিত হয়ে পড়ে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ে। দুর্যোগে এসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে পুনর্বাসনে সরকারের পাশপাশি বেসরকারি কয়েকটি সংগঠন তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। কাশিরহাট গ্রামটিতে বসবাসকারি লোকজনকেও পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে।

খুলনা গেজেট/ এস আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!