ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ড উপজেলায় করোনায় ক্ষতিগ্রস্থ খামারিদের প্রণোদনার তালিকা তৈরিতে নানা অনিয়ম ও প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। এ অভিযোগ উপজেলার প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ দপ্তরের এলএসপিদের (লাইভস্টক সার্ভিস প্রোভাইডার) বিরুদ্ধে।
তারা যেমন অ-খামারিদের খামারি বানিয়ে নিয়েছেন প্রণোদনার ভাগ তেমনি টাকার ভাগ দিতে অস্বীকার করায় তালিকায় নাম দেওয়া হয়নি প্রকৃত খামারিদের। আবার যারা প্রণোদনার এই টাকা পেয়েছেন তাদের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে প্রতারণা করে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে লাখ লাখ টাকা।
খামারির তালিকা থেকে বাদ পড়া প্রকৃত খামারি, খামারি না হয়েও টাকা পেয়েছেন এবং টাকা পেয়েও প্রতারণার শিকার হয়েছেন এমন ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। খোঁজ খবর নিতে অভিযুক্তদের সাথে কথা বলার পর শুরু হয়েছে টাকা ফেরত দেওয়ার তোড়জোড়।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, করোনাকালে ক্ষতিগ্রস্থ হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশুর খামারিদের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রণোদনা দেয় সরকার। বিশ্ব ব্যাংকের এলডিডিপি প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে এই প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার প্রথম পর্যায়ে ২৩৮৫ জন ও দ্বিতীয পর্যায়ে ৪৮২জন খামারির তালিকা অ্যাপসের মাধ্যমে পাঠানো হয়। ডেইরি, ব্রয়লার, লেয়ার, হাঁস ও সোনালী মুরগিসহ মূল পাঁচ ক্যাটাগরির খামারিদের এই তালিকার আওতায় আনা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ টি সাব-ক্যাটাগরিতে সর্বনিম্ন তিন হাজার তিনশ‘ পঁচাত্তর টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২২ হাজার পাঁচশ’ টাকা করে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে নগদ ও বিকাশ এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্থ খামারিদের এইসব টাকা পাঠানো হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথম পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্থ খামারিদের এই তালিকা প্রস্তুত করেন প্রাণিসম্পদ দপ্তরের এলএসপি ও তাদের মনোনীত একটি প্রতারক চক্র। পরে তালিকা প্রস্তুতে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেলে দ্বিতীয় পর্যায়ের তালিকা প্রস্তুতের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় জনপ্রনিধিদের। এখানেও রয়েছে ওই এলএসপিদের ভূমিকা। নিয়ম অনুযায়ী ডেইরি ক্যাটাগরিতে যারা সর্বনিম্ন ২টি ও সর্বোচ্চ ২০টি গাভী পালন করেন সেই খামারিরা এই প্রণোদনার আওতায় আসবেন। সোনালী মুরগির ক্ষেত্রে একশ‘ থেকে শুরু করে এক হাজার বা তার অধিক খামারিরা পাবেন এই প্রণোদনা। ব্রয়লার মুরগিতে প্রণোদনার আওতায় আসবেন পাঁচশ‘ থেকে দুই হাজার ও তার ওপরের খামারিরা। দুইশ’ থেকে এক হাজার প্লাস খামারিরাও আসবেন প্রণোদনার আওতায়। আর একশ‘ থেকে পাঁচশ‘র অধিক হাঁসের খামারিরাও পাবেন এই প্রণোদনা। এসব তালিকা প্রস্তুতের ক্ষেত্রেও মানা হয়নি কোন নিয়ম-কানুন। টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় বাদ দেওয়া হয়েছে প্রকৃত অনেক খামারিকে। আবার টাকা দিতে রাজি হওয়ায় প্রণোদনা পেয়েছেন অনেক অ-খামারিরা। এ অবস্থা উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নেই। নগদ ও বিকাশ এ্যাকাউন্টে যেসব খামারিদের টাকা এসেছে তাদের কাছ থেকে অভিনব কায়দায় লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রাণিসম্পদ দপ্তরের ওইসব এলএসপিরা।
তালিকা প্রস্তুতের সময় কাগজপত্র, নগদ ও বিকাশ এ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়ার কথা বলে সহজ-সরল এসব খামারিদের দেওয়া হয়নি পিন নম্বর। পরে আপনি টাকা পেয়েছেন কী না দেখি বলে অনেক খামারির এ্যাকাউন্ট থেকে ৪-৫ হাজার টাকা করে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে লাখ লাখ টাকা। এমন অভিযোগ উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নের এলএসপিদের বিরুদ্ধে।
উপজেলার বাকচুয়া গ্রামের শাহেরা বেগম নামে এক ব্রয়লার মুরগির খামারি জানান, এক সপ্তাহ আগে মাঠকর্মি সুজন মিয়া আমার বাড়িতে এসে বলেন আপনার মোবাইলে প্রণোদনার টাকা এসেছে কী না। আমার মোবাইলে এ্যাকাউন্ট খোলা নেই জানালে তিনি আমার মোবাইল ফোনটি নিয়ে যান। এরপর তিনি আমাকে সাত হাজার টাকা দেন। পরে আমার ছেলে আমার মোবাইল ফোনে দেখে ১১ হাজার চারশ‘ পঞ্চাশ টাকা ক্যাশ আউট করা হয়েছে। তখন সুজন মিয়াকে ডেকে বাকি টাকা চাইলে সে বলে এই টাকা অফিসের স্যারদের মিষ্টি খেতে দিতে হবে। না দিলে আপনাদের নাম কেটে দেওয়া হবে। প্রণোদনার টাকাও ফেরত দিতে হবে।
একই অভিযোগ ওই ইউনিয়নের লক্ষীপুর গ্রামের ব্রয়লার খামারি জুয়েল রানা ও টিপু সুলতানের। তারাও জানান একই কায়দায় প্রতারণার মাধ্যমে ৪ হাজার করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন মাঠকর্মি সুজন মিয়া। তবে আপনারা এ নিয়ে ঘাটাঘাটি করার কারণে পরে সে এসে ক্ষমা চেয়ে রাতের আধারে ওই চারহাজার টাকা ফেরত দিয়ে যায়।
জানতে চাইলে এই অভিযোগ অস্বীকার করে অভিযুক্ত ভ্যাক্সিনেটর সুজন মিয়া বলেন, এলাকায় সামাজিক বিরোধ রয়েছে তাই একটি পক্ষ আমার নামে মিথ্যা বদনাম ছড়াচ্ছে।
উপজেলার তাহেরহুদা গ্রামের তরিকুল ইসলাম নামে একব্যক্তি জানান, ওই গ্রামের ইউপি সদস্য সাব্বিরের বাবা আব্দুস সাত্তার ও মহিলা মেম্বরের স্বামী মুকুল হোসেনের খামার নেই তবুও তারা গাভী পালন খামারি হিসেবে প্রণোদনার টাকা পেয়েছেন।
কাঁপাশহাটিয়া গ্রামের সাদ্দাম হোসেন নামে আরও একব্যক্তি জানান, আমি একজন প্রকৃত খামারি, কিন্তু আমি প্রণোদনার টাকা পায়নি। আবার যারা টাকা পেয়েছেন তাদের অধিকাংশেরই কোন খামার নেই। আর এই তালিকা কবে কখন কারা করেছে এটাও জানেন না এই খামারি।
খামারি না হয়েও প্রণোদনার টাকা পাওয়া ওই গ্রামের আব্দুস সাত্তারের ছেলে ইউপি সদস্য সাব্বির হোসেন বলেন, আমার বাবার আগে দুইটি গাভী ছিল এখন একটি বিক্রি করে ফেলেছে।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ডা. সুলতানা বেগম বলেন, প্রতিটি খামারির টাকা এসেছে তাদের নগদ বা বিকাশ এ্যাকাউন্টে। কাজেই সেখান থেকে অন্য কারও টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। আপনাকে মিষ্টি খেতে দেওয়ার কথা বলে টাকা নেওয়া হয়েছে বলে জানতে চাইলে তিনি বলেন এমন কথা ওই মাঠকর্মি বলে থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মশিউর রহমান প্রতিবেদকে বলেন, আমরা স্বচ্ছভাবে প্রণোদনার তালিকা প্রস্তুত করেছি। যদি এমন কোন ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আনন্দ কুমার অধিকারী বলেন, উপজেলা পর্যায়ে কমিটির সভা করে জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে তালিকা নিয়ে তা যাচাই-বাছাই করে প্রস্তুত করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে তালিকায় অনিয়মের কোন সুযোগ নেই। তবে ভুক্তভোগীদের নিকট থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্তে টাকা নেওয়ার বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া গেলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে বিভাগীয় মামলার কথাও জানান এই কর্মকর্তা।
এই প্রকল্পের উপজেলা ইমার্জেন্সি এ্যাকশান প্লান কমিটির সভাপতি ও ইউএনও সৈয়দা নাফিস সুলতানা বলেন, ইতোমধ্যে এ বিষয়ে আমাকে মৌখিকভাবে কয়েকজন জানিয়েছেন। লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট সুপারিশ করা হবে।
খুলনা গেজেট/ টি আই