উজানের ঢল আর বৃষ্টির পানিতে হবিগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। জেলার আটটি উপজেলার মধ্যে সাতটিই এখন কম-বেশি বন্যাকবলিত।
আজমিরীগঞ্জ, নবীগঞ্জ, বানিয়াচং, লাখাই ও হবিগঞ্জ সদর উপজেলার পর নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে মাধবপুর ও বাহুবল উপজেলা। প্রতিদিন ডুবছে নতুন নতুন এলাকা। পরিবারের সদস্য আর গবাদি পশু নিয়ে মানুষ ছুটছেন আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে। পর্যাপ্ত ত্রাণ না পৌঁছায় খাবার সঙ্কটে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন বানভাসি এসব মানুষ।
উপজেলাগুলোর প্রায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশনা না আসায় বিপাকে পড়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে যেতে হচ্ছে তাদের।
এদিকে বহুবল উপজেলার স্নানঘাট, সাতকাপন ও লামাতাশি ইউনিয়নের বেশির ভাগ গ্রামই এখন বন্যার পানিতে ভাসছে।
ইতিমধ্যে অমৃতা, খাগাউড়া, কালাপুর, মুদাহরপুর, বাগদাইর, নিধনপুর, লালপুর, হোসেনপুর, শ্যামপুর, গোয়ালবাধা, ফতেহপুর, চকহায়দর, স্নানঘাট, স্বস্থিপুর, বক্তারপুর, সারংপুর, সোয়াইয়া, তারাপাশা, হাজীপুর, চানপুর, ধনিয়াখালী, লামা নোয়াগাঁও, কাজীহাটা গ্রামগুলো বানের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া বাহুবল সদর ও ভাদেশ্বর ইউনিয়নের একাধিক গ্রামে করাঙ্গী নদীর পানি প্রবেশ করেছে। সব মিলিয়ে উপজেলার শতাধিক গ্রামই এখন কমবেশি বন্যা উপদ্রুত।
এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি স্নানঘাট ইউনিয়নে। সেখানে কয়েকশ’ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভেসে গেছে কয়েকশ’ পুকুর ও মাছের ঘের। তলিয়ে গেছে কয়েকশ’ হেক্টর ফসলি জমি ও বিস্তীর্ণ সবজির মাঠ। এতে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকরা। এ ইউনিয়নের সিংহভাগ গ্রামের ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ায় গবাদিপশু, ধানচাল নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা। ইতিমধ্যে প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবার স্নানঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে।
বন্যা দুর্গত এলাকাগুলোতে সরকারি ত্রাণ তৎপরতা চালানো হলেও সেটা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এদিকে, বন্যায় উপজেলার ভাটি অঞ্চলের প্রায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই পানি ঢুকে পড়েছে। স্নানঘাট ইউনিয়নের ফতেহপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, সাতকাপন ইউনিয়নের রাসুলপুর সুন্নীয়া দাখিল মাদ্রাসা ও সদর ইউনিয়নের দীননাথ ইনস্টিটিউশন সাতকাপন সরকারি হাই স্কুলে পানি ঢুকে পড়ায় পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে।
তাছাড়া খাড়াউড়া, অমৃতা, মুদাহরপুর, স্নানঘাট, স্বস্থিপুর, হোসেনপুর, চকহায়দর, বক্তারপুর, মানিকপুর, জগতপুর, অলুয়া, পনারব্দা, হাবিজপুর, হাজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
হাবিজপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাওলানা নূরুল আমীন বলেন, আমাদের বিদ্যালয় তথা নিম্নাঞ্চলের সব কয়টি বিদ্যালয়ে হাটু পানি প্রবেশ করেছে। কোন কোনটিতে কোমর পানিও আছে। স্কুল বন্ধের সরকারি কোন নির্দেশনা না থাকায় এখনও পানিতে ভিজেই বিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের যেতে হচ্ছে।
স্বস্তিপুর গ্রামের নূর উদ্দিন জানান, বন্যার পানি ঘরে প্রবেশ করায় জরুরি মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু কতটা পারবো সেটা জানি না। হাওরে গত কদিনে পানি বৃদ্ধির ফলে সব ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়ায় যতটা দুশ্চিন্তায় ছিলাম, এখন ঘরে পানি প্রবেশ করায় পুরোপুরি দিশাহারা হয়ে পড়েছি। সবচেয়ে বেশি বিপদে আছি গবাদি পশু নিয়ে। গবাদি পশু রাখা ও তাদের খাবার যোগান দেয়া মারাত্মক কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল আউয়াল জানান, উপজেলার নিম্নাঞ্চলে হঠাৎ করে বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রায় ৮৫০ হেক্টর ফসলি জমি পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। এ পানি আগামী ৩/৪ দিন পর্যন্ত অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকলে ফসলি জমিগুলো শতভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মিসবাহ উদ্দিন আফজল বলেন, উপজেলার প্রায় দুই শতাধিক পুকুর ও মাছের ঘের পানিতে ভেসে গেছে। এতে প্রায় কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে তার ধারণা।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মহুয়া শারমিন ফাতেমা বলেন, “উপজেলার হাওরাঞ্চলের প্রায় গ্রামই বন্যা কবলিত। গত ক’দিন ধরে স্নানঘাট ইউনিয়নের একাধিক গ্রামে বন্যার্তদের মাঝে দুই শতাধিক প্যাকেট ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছি। এছাড়াও স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদে দুই টন চাল বরাদ্দ দিয়েছি। এদিকে, বুধবার বিকালে হবিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিজেন ব্যানার্জী উপজেলার স্নানঘাট ইউনিয়নের খাগাউড়া আশ্রয়ণ প্রকল্প ও অমৃতা গ্রাম পরিদর্শন করে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছেন।