খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড

অনুবাদ : গাজী আবদুল্লাহেল বাকী

(September on Jessore Road এ্যালেন গিনসবার্গ (Allen Ginsburg)এর একটি বিখ্যাত গীতিকাব্য। তিনি ১৯২৬ সালে আমেরিকার নিউজার্সিতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৯৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৫৬ সালে তার ঐড়ষি নামক কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে তিনি বিশ্বজোড়া কবি খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম বাংলার যশোর রোডে হাজার হাজার পরিবারের করুণ দুর্দশা স্বচক্ষে দেখেন এবং আবেগ আপ্লুত হয়ে এই কবিতাটি রচনা করেন। কবিতাটি গীতিধর্মী হওয়ায় বিশ্বময় গাওয়া হয়।)

লক্ষ শিশু আকাশ পানে তাকিয়ে আছে
গোল বড়ো আখিঁসহ পেট তাদের ফুলে আছে
যশোর রোড বরাবর অসংখ্য বাঁশের ঘর
বালুময় চাকার খাঁদই একমাত্র শৌচাগার

লক্ষ পিতা বাদলের ধারায়
লক্ষ মাতা বেদনার ঘায়
লক্ষ ভায়ের দুঃখে অবস্থান
লক্ষ বোনের যাবার নেই কোনো স্থান

দশ লাখ নারী-স্বজন মরছে ধুঁকে
দশ লাখ পুরুষ-আপন কাঁদছে শোকে
লক্ষ পিতামহ দুঃখের মাঝে গৃহহারা
লক্ষ মাতামহ নীরবতায় পাগলপারা

লক্ষ কন্যা কাদা ভরা পথে চলে
লক্ষ শিশু সাফ হয় বানের জলে
দশ লাখ মেয়ে করে বমি ও আর্তনাদ
লক্ষ পরিবার পায় শুধু নিরাশার স্বাদ

উনিশ-শ’ একাত্তরে লক্ষ হাজার মানব দল
গৃহহারা যশোর রোডে ধুসর রঙা তপন তল
ঝরছে যেথা লক্ষ জান চলছে লক্ষ প্রাণের বান
কলকাতা অভিমুখে–হতে পূর্ব পাকিস্তান

যশোর রোড ধরে চলে সেপ্টেম্বরে ট্যাক্সি গাড়ী
টানে কাঠ-কয়লা ভরা জীর্ণ গরুর গাড়ী
জলে ভরা মাঠ আর পেরিয়ে বর্ষার খাদ
ঘুটে ভরা গাছের গুড়ি, প্লাস্টিকের আটা ছাদ

ভিজে মিছিলে পরিবার সব চলে হেঁটে
নির্বাকে মাথা মোটা ছেলের দল বেঁটে
চমকে হাড্ডিসার খুলি নীরব গোল আঁখি
উপসী কৃষ্ণ দেবদূত মানববেশে নাকি

উবু হয়ে কাঁদছে মা তাকিয়ে ছেলেদের দিকে
বয়সী সন্যাসীনির ন্যায় পা যার লিকলিকে
মুখের পানে ছোট হাত ভংগিতে প্রার্থনার
এখানে আসার পর পেয়েছে পাঁচ মাসে অল্প খাবার

ছোট একটি খালি পাত্র সাথে মেঝের মাদুর
পিতা তোলে হাত উঁচুতে তাদের নিয়তি দূর
মায়ের চোখ হতে গড়ায় অশ্রু নীরব ধারায়
’মায়া’ মা ওঠে কেঁদে আতিশয্যে বেদনায়

তালপাতার ছায়ার নীচে দুটি শিশু একসাথে
হানে আমার দিকে দৃষ্টি আরও নির্বাক তাতে
রেশনের চাল-ডাল একবার পেয়ে থাকে সপ্তায়
নম্র যুদ্ধক্লান্ত শিশুরা গুড়া দুধ পায়

নেই কোনো সবজি অর্থ আর কাজ পুরুষের
খায় নিজের মতো চার দিন চলে চাল রেশনের
তিন দিন শিশুদের উপোস একাধারে যায়
করে বমি খাওয়ার পর যদি ধীরে না খায়

যশোর রোডে কেঁদেছিলো মা হাটুর পাশে আমার
দয়া করুণ জনাব–বংলায় করেছিলো চিৎকার
পড়ে আছে ছেঁড়া পরিচয় পত্রটি মেঝের গায়
এখনও অপেক্ষমান স্বামী ক্যাম্প অফিসের দরজায়

শিশুটি খেলায় রত আমি হয়েছি সাফ বানের জলে
এখন দিবে না তারা আর খাদ্য আমাদের ভালে
সেলুলয়েড ব্যাগে আমার খুচরো মূদ্রা–নিষ্পাপ
শিশুটি খেলে যায় আমাদের মৃত্যু অভিশাপ

ঘিরে আছে দুটি পুলিশ হাজার ছেলের দল
খাবার নিতে আসছে দিনের সেই আনন্দ ঢল
লাঠি আর বাঁশি নিয়ে তাড়ায় হামেশা
পূনঃ লাইনে–তারা খেলছে ক্ষুধার্ত তামশা

লাইন ভেঙ্গে লাফ দিয়ে সামনে বাড়ে
গণ্ডির মাঝে চর্ম্মসার এক বেঁটে চুপিসারে
সামনে কাঁদার মঞ্চে নেচে ওঠে দুই ভাই
বাঁজিয়ে বাঁশি প্রহরীরা রাগে তাড়ায় তাই

দলে দলে কেনো শিশু হচ্ছে জড়ো এস্থানে
হাসছে খেলছে তারা আর ধাক্কাধাক্কি এখানে
খুশি আর ভয়ে কেনো তারা অপেক্ষা করে
কেনো তাড়া দেয় শিশুদের খাবার এই ঘরে

চিৎকার দিয়ে আসে বাইরে দরজার দারোয়ান
গ্রহণ করে ছেলেমেয়েরা তার উচ্চ আওয়াজখান
এটা কি আনন্দ? এটা কি প্রার্থনা? ’’নেই কোনো রুটি আজ ঘরে’’
হাজার সন্তানেরা চিৎকার দিয়ে ওঠে ’’হুররে’’!

ছুটে যায় তাবুতে যেথা বড়োরা অপেক্ষমান
বার্তাবাহী শিশুরা আনবে খাবার সরকারী দান
আজ কোনো খাবার নেই! নেই কোনো জায়গা বসার
বেদনার্ত রুগ্ন শিশু, করেছে পেট খারাপ তার

মাসের পরে মাস অপুষ্টিতে রুগ্ন হাজার
আমাশয় করছে খালি অন্ত্রনালী দ্রুত একাকার
নার্স দেখায় রোগ নির্ণয় কার্ডে এনটেরোষ্ট্রেপ যম
স্থগিতের দাওয়া প্রয়োজন বা আমাশার উপশম

শরনার্থী ক্যাম্পে চালা হাসপাতাল
ন্যাংটো নবোজাতক মায়ের কোলে রুগ্ন হাল
সপ্তাহ বয়সী বানর আকারের বাত-চোখ সনে
মরছে হাজারো গ্যাষ্ট্রোএনটেরাইটিস রক্ত দূষণে

সেপ্টেম্বরে রিকশায় যশোর রোডের পাশ
দেখেছি একটি ক্যাম্পে আমি হাজার পঞ্চাশ
পানিতে সারি সারি কুঁড়ে ঘর তৈরী বাঁশের
নালার পাশে পরিবার সব ভিজে প্রত্যাশী খাদ্যের

ট্রাকভরা খাদ্য বর্ডারে পারেনা আসতে কোন কানুন
মার্কিন দূতযন্ত্র দয়া করে দ্রুত আসুন?
কোথায় রাষ্ট্রদূত বাংকার আজ?
ক্রীড়ারত শিশুদের গুলি করা কি তার আকাশযানের কাজ?

ইউএস এইড এর হেলিকপ্টার কোথায়?
মাদক চোরাচালানে ব্যাঙ্ককের সবুজ ছায়ায়।
কোথায় আমেরিকার আলোর বাহিনী বিমান?
উত্তর লাওসে ফেলছে বোমা রাতদিনমান

কোথায় রাষ্ট্রপতির স্বর্ণ সেনারা?
সাহসী দয়াবান কোটিপতি নৌ-সেনারা?
আসছে নিয়ে কি আমাদের অষুধ খাবার রিলিফ?
উত্তর ভিয়েতনামে ফেলে নাপাম ঢালছে তকলিফ?

কোথায় অশ্রু আমাদের? এ ব্যথার জন্য কে আছে কাঁদার?
কোথায় যেতে পারে বর্ষার মাঝে এসব পরিবার?
মোটা চোখ বন্ধ করে যশোর রোডের সন্তানেরা
যখন মৃত ’আমাদের পিতা’ কোথায় ঘুমোবো আমরা?

কার কাছে করবো প্রার্থনা উদ্দেশ্যে ভাত ও সেবার
এ নোংরা প্রবাহ পশুস্থানে পারে কে আনতে খাবার?
লক্ষ শিশু বাদলের মাঝে একাকী!
অসংখ্য শিশু কাঁদছে ব্যাথায় একি!

তাদের দুঃখের তরে পৃথিবীর ভাষা সব ওঠো বেজে
অজানা ভালোবাসার জন্যে কণ্ঠগুলো ওঠো বেজে
তড়িৎময় ব্যাথার ঘণ্টাগুলো তুমি বাজাও
জাগ্রত মার্কিন মস্তিস্কে তুমি বাজাও

আমাদের কতো শিশু কোথায় হারিয়ে গেছে
আমরা দেখি কাদের এ কন্যাগুলো মারা গেছে?
আমাদের আত্মা কেমনে হারিয়েছে সেবার ভিত?
যদি সাহস করে কেঁদে ওঠো বেজে ওঠো সঙ্গীত-

চালাঘর বালু নালার পাশে কাদায় কান্না বাজে
বর্ষায় নোংরা মাঠে ঘুমায় বিশাল পাইপের মাঝে
পৃৃথিবীর প্রতি দূঃখ! করে প্রতীক্ষা পাম্প কুয়ার পাশে
যার সন্তানেরা এখনও মায়ের বাহুতে কুঁকড়ে উপোসে

এটা কি তাই আমি যা করেছি নিজের প্রতি অতীতে?
কবি সুনীলকে জিজ্ঞাসিবো করবো কি আমি ভবিষ্যতে?
এগিয়ে চলো অর্থ-কড়ি ছাড়া যাও কি ছেড়ে তাদের?
আমার কি যত্ন নেওয়া উচিৎ ভালোবাসা পৌরুষের?

আমাদের শহর আর গাড়ির যত্ন নেয়া উচিৎ কি?
মঙ্গল গ্রহে নিম্নমানের খাবার কিনবো আমরা কি?
লক্ষ লক্ষ কতো জনে বসে নিউইয়ার্কে দিচ্ছে চুমুক
এই রাত্রির টেবিলে শুকরের রোষ্ট আর হাড়ে দিয়ে মুখ?

করছে তারা নিক্ষেপ ভাঙ্গু মদের কতো শত
মাতৃসম সাগরে? এর মূল্য কতো?
পেট্রাল সিগারেট এ্যাসফ্যালট গাড়ি স্বপ্নের সভা
পৃথিবীতে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ আর করছে স্নান তারার প্রভা–

এক দীর্ঘশ্বাসে যুদ্ধকে করো বর্জন মধ্যে বুকের
এসো নাও কান্নার স্বাদ তোমার ’মানবীয়’ চোখের
লক্ষ লক্ষ রুগ্ন সন্তানের করো দয়া
টিভির পর্দায় দেখো ’সামসারা’য় অভুক্তদের ছায়া

মরবে আরো অধিক কতো লক্ষ হাজার সন্তান
আগেই ’মহান প্রভু’কে ’সৎ মায়েরা’ কি বুঝতে চান?
কতো সৎ পিতারা দিয়ে যায় ট্যাক্স পুনঃগঠনের
করে গর্ব সেনারা হত্যা করে তাদের সন্তানদের?

কতো আত্মা যায় হেঁটে ’মায়া’র ব্যাথার পথ ধরে
কতো ছোট শিশু যখন মায়াময় বৃষ্টি ঝরে?
কতো শত পরিবার কোটরাগত চোখে হারিয়ে যাচ্ছে?
কতো শত মাতামহ শীর্ণ হয়ে পড়ছে?

কতো আছে আপনজন কখনো পাইনি একটু খাবার?
কতো শত স্বজন-নারী নিয়ে আছে গর্ত মাথার?
কতো বোনদের খুলি পড়ে আছে মাটির পর?
কতো শত পিতামহের নেই কোনো শব্দ চিৎকার?

কতো পিতারা আছেন দুঃখে কষ্টেতে
কতো পুত্রের যাবার নেই জায়গা পৃথিবীতে
কতো কন্যাদের নেই কোনো খাবার-ভাতা?
কতো স্বজন-পুরুষের ফোলা রুগ্ন পায়ের পাতা?

লক্ষ লক্ষ শিশু আজ বেদনার ঘায়
লক্ষ লক্ষ মায়েরা আজ বাদলের ধারায়
লক্ষ লক্ষ ভায়ের নেই দুঃখের অবসান
লক্ষ লক্ষ সন্তানের যাবার নেই কোনো স্থান।

মূল: এ্যালেন গিনসবার্গ

নিউ ইয়র্ক, নভেম্বর ১৪-১৬, ১৯৭১

গাজী আবদুল্লাহেল বাকী একজন কবি, গবেষক, অনুবাদক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!