বিদেশে অর্থ পাচার করার ঘটনায় দেশের কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ‘ধ্বংসের প্রান্তে’ নিয়ে যাওয়া প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের সহযোগী হিসেবে নাম আসার পরও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী ও বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কেন এখনও গ্রেপ্তার করছে না, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। দুদক তাদের গ্রেপ্তারের পদক্ষেপ না নিলে আদালত এ বিষয়ে আদেশ দিতে বাধ্য হবে বলে জানিয়ে দিয়েছেন বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ।
আজ সোমবার এ বিষয়ে শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। দুদকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তানজীব-উল আলম ও খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ।
শুনানির একপর্যায়ে বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার দুদকের আইনজীবীর কাছে জানতে চান, পি কে হালদারের অর্থ আত্মসাৎ এবং পাচারের মামলায় গ্রেপ্তার যারা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন এবং সেই জবানবন্দিতে যাদের নাম উঠে এসেছে, তাদের বিষয়ে দুদক কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
জবাবে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, জবানবন্দিতে যাদের নাম এসেছে, তাদের কাউকে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কেউ কেউ পলাতক।
এ সময় আদালত বলেন, এস কে সুর ও শাহ আলমের নাম বিভিন্ন মাধ্যমে আসছে। তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না কেন?
জবাবে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, কমিশনের চিঠির ভিত্তিতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) তাদের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করেছে।
বিচারক তখন দুদকের আইনজীবীর কাছে প্রশ্ন রাখেন- গ্রেপ্তার করছেন না কেন? আপনারা পদক্ষেপ না নিলে আদেশ দিতে বাধ্য হব। আগে, তাদের ধরেন। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে মেহমানদারি করতে পারেন না। তাদের অবশ্যই কারাগারে নিতে হবে।
পি কে হালদারের দুই সহযোগী ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাশেদুল হক ও পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী আদালতে যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, সেখানে এস কে সুর ও শাহ আলমের নাম আসে।
পিপলস লিজিংয়ের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারীরাও বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই দুই সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলে আসছেন। ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ আমানতকারীর আবেদনে হাইকোর্ট গত ৫ জানুয়ারি ২৫ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যাদের মধ্যে এস কে সুর চৌধুরীর নামও ছিল।
অভিযোগ ওঠার পর গত ৪ ফেব্রুয়ারি নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলমকে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে তিনি অন্য বিভাগের দায়িত্ব পালন করছেন। আর এস কে সুর চৌধুরী ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ডেপুটি গভর্নরের পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি অবসরে রয়েছেন।
পি কে হালদার নানা কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন।
বিদেশে পালিয়ে থাকা পি কে হালদারকে গ্রেপ্তারে ইতোমধ্যে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস জারি করা হয়েছে। ভুয়া ও কাগুজে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৫১ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন ও আত্মসাতের অভিযোগে পি কে হালদারসহ ৩৩ জনের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা করেছে দুদক।
এর আগে গত ১ মার্চ হাইকোর্টে ইমিগ্রেশন পুলিশের দেওয়া প্রতিবেদনে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়কে জানানো হয় যে, প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারের বিদেশে পালানোর ক্ষেত্রে ইমিগ্রেশন পুলিশের গাফিলতি ছিল না। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নয়, যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে সড়ক পথে দেশত্যাগ করেছেন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পি কে হালদার।
২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর দুদক ইমিগ্রেশন পুলিশকে ডাকযোগে চিঠি দেয় পি কে হালদার যেন দেশত্যাগ না করতে পারেন। ওই চিঠি ইমিগ্রেশন পুলিশ হাতে পৌঁছায় ২৩ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৪টায়। তার ৫৩ মিনিট আগেই (২৩ অক্টোবর বিকেল ৩টা ৩৭ মিনিটে) পি কে হালদার বেনাপোল দিয়ে দেশত্যাগ করেন। অর্থাৎ পি কে হালদারের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারির চিঠি পাওয়ার আগেই তিনি দেশত্যাগ করেন।
এর আগে চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি পি কে হালদারের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও কীভাবে দেশত্যাগ করলেন তা জানতে চান হাইকোর্ট। একই সঙ্গে পি কে হালদার যেদিন দেশত্যাগ করেছিলেন, সেদিন বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনের দায়িত্বরতদের এবং দুদকের দায়িত্বে কে কে ছিলেন তার তালিকা দাখিল করতে বলেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের তিনটি বিভাগে ২০০৮ সাল থেকে কর্মরতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকার বিষয়ে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, আগামী ১৫ মার্চের মধ্যে তা জানাতে বলা হয়।
গত বছরের ১৮ নভেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে ‘পি কে হালদারকে ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা চাইবে দুদক’ শীর্ষক প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে নিয়ে গত ১৯ নভেম্বর তাকে বিদেশ থেকে ফেরাতে এবং গ্রেপ্তার করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা জানতে চেয়ে স্বপ্রণোদিত আদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। ওই আদেশের ধারাবাহিকতায় গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ওই আদেশ দেন হাইকোর্ট।
জানা যায়, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা পাচার করে কানাডায় পাড়ি দেন পি কে হালদার। দেশত্যাগের সময় পি কে হালদার বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করেছেন।
খুলনা গেজেট/এনএম