রাজধানীর বারিধারায় পুলিশের গুলিতে পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ সদর দপ্তর। হত্যাকান্ডের ঘটনায় হতবাক পুলিশ কর্মকর্তারাও। সাত দিনের রিমান্ডে থাকা কনস্টেবল কাওসার আলী তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কাছে বারবার দাবি করছেন, তিনি ইচ্ছা করে তার সহকর্মীকে মারেননি। তিনি ‘পারিবারিক ও চাকরির চাপে’ ঝামেলায় দীর্ঘদিন ধরেই হতাশাগ্রস্ত। এমনকি তার পরিবারও দাবি করেছে, তাকে পাবনার মানসিক হাসপাতালে কয়েক দফা চিকিৎসা করানো হয়েছে।
এ ঘটনার পর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পুলিশের সব কটি ইউনিটপ্রধানদের কাছে হতাশাগ্রস্ত পুলিশ সদস্যদের বিষয়ে খোঁজ নিতে একটি নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। যারা হতাশার মধ্যে আছেন, তাদের কাউন্সেলিংয়ের আওতায় আনা হচ্ছে। তালিকা করে পুলিশ সদর দপ্তরকে অবহিত করতে বলা হয়েছে।
মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা জানিয়েছেন, দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই নিরাপত্তার জন্যই পুলিশ সদস্যরা কাজ করছেন। সংসারেরও নানা সমস্যার মধ্যে থাকছেন কেউ কেউ। পোশাক ও আধুনিক অস্ত্র-সরঞ্জাম দেওয়া হলেও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখাসহ পারিপাশির্^ক সুযোগ-সুবিধা থেকে এখনো অনেকটা বঞ্চিত কিছু পুলিশ সদস্য। মাঠপর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের ডিউটির পরিবেশ ও তাদের মানসিক স্বাস্থ্যসহ সার্বিক বিষয়ে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে ঊর্ধ্বতনদের।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘পুলিশ কনস্টেবল নিহত হওয়ার ঘটনায় নিজেদের কোনো গাফিলতি ছিল কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, কথা-কাটাকাটির পর গুলি করেছে, তার কাছে এসএমজি ছিল। এসএমজি দিয়ে ফায়ার করা হয়েছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজন ঘটনা। ঘটনা শুনে আসলেই আমরা সবাই বিচলিত হয়েছিলাম এক কনস্টেবল আরেক কনস্টেবলকে কেন হত্যা করবে। এ বিষয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। মামলা হয়েছে। তিনি (খুনি কনস্টেবল) এখন রিমান্ডে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আমার মনে হয় তদন্তের পরই সঠিক ঘটনা জানা যাবে।’
তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যা শুনেছি হয়তো তার পারিবারিক কোনো অসুবিধা থাকতে পারে বা অন্য কোনো কিছু থাকতে পারে। কাজেই এখনই সুনির্দিষ্টভাবে কোনো কিছু আমরা বলতে পারছি না। আমরাও উদ্বিগ্ন এ কারণে যে, একজন পুলিশের কাছে অস্ত্র ছিল, কী এমন কারণ ঘটেছিল তাকে ফায়ার ওপেন করতে হয়েছে?’
তালিকা করার বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বারিধারার ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। শুধু ঢাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে তা না। ঢাকার বাইরে হতাশা থেকে পুলিশ সদস্যরা আত্মহত্যা করছেন। এসব রোধ করতে আমরা বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। ইতিমধ্যে হতাশাগ্রস্ত পুলিশের তালিকা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইউনিটপ্রধানদের বলা হয়েছে, যারা নানা কারণে হতাশার মধ্যে আছেন, তাদের বিষয়ে খোঁজ নিতে। চিকিৎসার প্রয়োজন হলে তা করাতে হবে। আমরা চাই না পুলিশের কোনো সদস্য এভাবে মারা যান।’
তিনি বলেন, ‘পুলিশ সদর দপ্তর এসব বিষয়ে কঠোর মনিটরিং করবে। প্রয়োজনে ডিউটি করার আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতেও বলা হয়েছে। ইউনিটপ্রধানদের বলা হয়েছে দ্রুত সময়ের মধ্যে হতাশাগ্রস্ত সদস্য থাকলে তাদের তালিকা করে পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠাতে।’
অপরাধ বিশ্লেষকরা জানান, একটি ফোর্সে অবশ্যই ‘সাইকোলজিস্ট’ (মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ) থাকা উচিত। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনী অত্যন্ত মানসিক চাপের একটি চাকরি। এখানে নিম্নস্তরের পুলিশ সদস্য থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে ব্যাপক মানসিক চাপ সহ্য করতে হয়। নানা প্রতিকূলতার মাঝে ডিউটি করতে হয়। এ বিষয়গুলো দেখা খুব জরুরি। তা না হলে মানসিক চাপে বা অস্থিরতা থেকে গুলশানের মতো অনাকাক্সিক্ষত এমন আরও বড় ঘটনা ঘটার শঙ্কা থাকবে।
পুলিশ সূত্র জানায়, গত তিন বছরে হতাশা থেকে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের অন্তত ১৮ জন সদস্য আত্মহত্যা করেছেন। ২০২২ সালের ২১ জুলাই নিজের রাইফেলের গুলিতে মেহেরপুরে পুলিশ সদস্য সাইফুল ইসলাম আত্মহত্যা করেছেন ঈদুল আজহার দিন সকালে। তার স্ত্রী জানিয়েছেন, কর্মব্যস্ততার কারণে দীর্ঘদিন পারিবারিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকায় ও সাক্ষাৎ না হওয়ায় তার হতাশা ছিল। এ ছাড়াও নানা জটিলতায় ছিলেন তিনি। ওই বছরের ১৫ জুলাই রাঙ্গামাটিতে নিজের বন্দুকের গুলিতে পুলিশ সদস্য কাইয়ুম সরকার আত্মহত্যা করেন। তিনি নানা পারিবারিক অশান্তিতে ভুগছিলেন। ২১ মার্চ সদ্য ৩৭তম আউটসাইড ক্যাডেট হিসেবে এসআই হয়ে পুলিশে আসা হাসান আলী পারিবারিক অসচ্ছলতার জন্য মানসিকভাবে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। তিনি পাবনার আতাইকুলা থানার ছাদে উঠে নিজের মাথায় গুলি করলে তিনি মারা যান। ২০২০ সালের ৬ মার্চ বরিশাল জেলা পুলিশ লাইনসের ব্যারাকের ছাদে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন পুলিশ কনস্টেবল হৃদয় দাস। গত বছরের ২৫ মে রাজধানীর বনানী চেকপোস্টের ওয়াশরুমে নিজের নামে ইস্যু করা অস্ত্র দিয়ে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন মোহাম্মদ রনি নামের একজন পুলিশ সদস্য। গত ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি ভোরে মিরপুর-১৪ নম্বরে পুলিশ লাইনস মাঠে নিজের ইস্যুকৃত অস্ত্র দিয়ে নিজের বুকে গুলি চালিয়ে মো. কুদ্দুস সাহা (৩১) নামের পুলিশের এক নায়েক আত্মহত্যা করেন। এ রকম ঘটনা ঘটছে অহরহ।
গুলশানে কূটনৈতিকপাড়ায় দায়িত্ব পালনকালে সহকর্মীকে গুলি করে হত্যা করা কনস্টেবল মো. কাওসার আলী আগে থেকেই ‘মানসিক রোগী’ ছিলেন। এ কারণে তাকে ৩ দফা পাবনায় মানসিক হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করানো হয়েছিল ডিএমপির পক্ষ থেকে। কাওসার আলীর পরিবারও তাকে মানসিক রোগী বলছে। এমন একজন ‘মানসিক রোগী’কে ডিপ্লোম্যাটিক সিকিউরিটি জোনে রাখা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মানসিক রোগী বা শারীরিকভাবে অসুস্থ অথবা মানসিকভাবে চাপে থাকলে পুলিশের যেকোনো সদস্য বা কর্মকর্তাকে পরিপূর্ণ সুস্থতার জন্য ছুটিতে পাঠানোর নিয়ম। তাহলে ‘অসুস্থ’ পুলিশ সদস্যকে কেন ডিপ্লোম্যাটিক জোনের মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর স্থানে ডিউটি দেওয়া হলো, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
খুলনা গেজেট/এইচ