ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার নদ-নদীতে জোয়ারের পানি অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় ওভার ফ্লো করে কমপক্ষে ১৫টি পয়েন্টে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বুধবার (২৬ মে) দুপুরে জোয়ারের পানি বেড়িবাঁধ উপচে ভিতরে প্রবেশ করার সময় এসব বাঁধ ভেঙ্গে যায়। স্থানীয় গ্রামবাসী চেষ্টা করেও এসব বাঁধ রক্ষা করতে পারেনি। পাউবো’র কর্মকর্তারা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে নিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া এসব বাঁধ দ্রুত সংষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এছাড়া সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বহু স্থানে নদ-নদীর পানি পাউবো’র বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয়ে ঢুকে বাজার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মৎস্য ঘের, ফসলি জমি, পুকুর, জলাশয় ও গ্রামীন সড়ক প্লাবিত করেছে। এলাকা প্লাবিত হওয়ায় শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের এক হাজার পরিবারকে ইতিমধ্যে স্থানীয় সাইক্লোন সেন্টারে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বাকিদের সরিয়ে নেয়ার কাজ চলছে।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বুধবার ভোর থেকে সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় বাতাসের গতিবেগ কিছুটা বৃদ্ধি পেতে থাকে। থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। মঙ্গলবার রাতের জোয়ারে প্রভাবে নদ-নদীর পানি গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়নের কয়েকটি স্থানে বেড়িবাঁধের উপর দিয়ে উপচে পড়ে। রাতে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের কেয়াখালে একটি জেলে নৌকা ডুবে গেলেও কোনো প্রাণহানি হয়নি। তবে উপকূলীয় মানুষের মধ্যে ঝড়ের চেয়ে জলোচ্ছ্বাসের আতংক বেশি ভর করে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বুধবার দুপুরে জেলার নদ-নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে প্রায় ৩/৪ ফুট পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সাতক্ষীরার উপক‚লীয় উপজেলা শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জ ও দেবহাটার বিভিন্ন পয়েন্টে পাউবো’র বেড়িবাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে ঢোকা শুরু করে। একপর্যায় স্রোতের টানে শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের জেলেখালী, চাঁদনিমুখা, গাগড়ামারি ও তিন নম্বরের ২টি পয়েন্টে, পদ্মপুকুর ইউনিয়নের বন্যতলা ও ঝাপা, কৈখালী ইউনিয়নের কৈখালী, কালিগঞ্জের বাঁশঝাড়িয়া, দেবহাটার শাকরা কোমরপুর এবং আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাউনিয়া, সুভদ্রাকাটি, রুইয়ারবিল, দিঘলারাইট ও হরিষখালী পয়েন্টে বাঁধ ভেঙ্গে যায়। এসব ভাঙ্গন পয়েন্ট দিয়ে প্রবল বেগে নদীর পানি লোকালয়ে ঢুকছে। এভাবে রাতের জোয়ারেও পানি ঢোকা অব্যহত থাকলে জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে লক্ষাধিক মানুষ।
এছাড়া শ্যামনগরের গাবুরার নেবুবুনিয়া, নাপিতখালি, পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পশ্চিমপাতাখালী বুড়িগোয়ালিনী, আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের চাকলা, আশাশুনি উপজেলা সদরের বাজার, আনুলিয়ার বিছট ও নাংলা এবং কালিগঞ্জের নাজিমগঞ্জ বাজার এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। এলাকাবাসী স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজ করে এসব এলাকায় নদীর পানি ঢোকা বন্ধ করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব এলাকায় পানি আটকানো সম্ভব না হলে যে কোন মূহুর্ত্বে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাবে। বেড়িবাঁধ উপচে পানি ঢোকায় শ্যামনগর উপজেলার নীলডুমুর এলাকায় নদীর ধারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে অনেকেই তাদের জিনিসপত্র সরিয়ে নিয়েছেন।
প্রতাপনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শেখ জাকির হোসেন জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটুয়া নদীতে বুধবার দুপুরে জোয়ারের পানি অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাউনিয়া, সুভদ্রাকাটি, রুইয়ারবিল, দিঘলারাইট ও হরিষখালী পয়েন্টে পানি ওভার ফ্লো করতে থাকে। একপর্যায় বেলা সাড়ে ১২টার দিকে কুড়িকাউনিয়া ও শুভদ্রকাটি এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যায়। পরে রুইয়ারবিল, দিঘলারাইট ও হরিষখালী পয়েন্টেও বাঁধ ভেঙ্গে যায়। গ্রামবাসীদের সাথে নিয়ে এসব পয়েন্টে জিও বস্তা ও মাটি দিয়ে উচু করে পানি আটকানোর চেষ্টা চালিয়ে কোন লাভ হয়নি।
তিনি আরো বলেন, গত বছরের ২০ মে আম্পানের আঘাতে প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাউনিয়া, চাকলা, শুভদ্রকাটি ও হরিষখালি এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে পুরো ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে যায়। অম্পানের সে ক্ষতি মানুষ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এর অবার প্লাবিত হলে প্রতাপনগর ইউনিয়ন মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। তিনি প্রতাপনগর বাসীকে রক্ষা করতে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেন।
গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম জানান, মঙ্গলবার রাতে জোয়ারে তার ইউনিয়নের কয়েকটি স্থানে বেড়িবাঁধ উপচে পানি গ্রামে ঢোকা শুরু করলে গ্রামবাসীকে সাথে নিয়ে তা আটকানো হয়। কিন্তু বুধবার দুপুরে কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটুয়া নদীতে জোয়ার অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় গাবুরা ইউনিয়নের জেলেখালী, চাঁদনিমুখা, গাগড়ামারি ও তিন নম্বরের ২টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যায়। ইউনিয়নের ১৫ টি গ্রামের মধ্যে এই মুহুর্ত্বে ৭টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে পড়েছে। স্থানীয়দের সাথে নিয়ে আমারা বাঁধ মেরামতের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
আনুলিয়া ইউনিয়নের বিছট গ্রামের বাসিন্দা সাতক্ষীরা জেলা পরিষদ সদস্য আব্দুল হাকিম জানান, দুপুরের জোয়ারে খোলপেটয়া নদীর পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় বিছট গ্রামে মোড়ল বাড়ির সামনে বেড়িবাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে ঢোকা শুরু করে। এসময় গ্রামবাসী দ্রুত ওই বাঁধে কাজ করে পানি আটকাতে সামর্থ হয়। রাতে যদি জোয়ার আরো বৃদ্ধি পায় তাহলে এই বাঁধ রক্ষা করা কোন ভাবেই সম্ভব হবে না।
তিনি আরো বলেন, আনুলিয়া ইউনিয়নের নাংলা এলাকায় কপোতাক্ষ নদের পানি বেড়ি বাঁধ উপচে লোকায় প্রবেশ করছে। স্থানীয় গ্রামবাসী স্বেচ্ছা শ্রমের ভিত্তিতে কাজ করে সেখানে পানি আটকানোর চেষ্টা করছে।
পদ্মপুকুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান জানান, তার ইউনিয়নের বন্যতলা ও ঝাপা এলাকায় বাঁধ ভেঙ্গে যায়। এছাড়া পশ্চিমপাতাখালী পয়েন্টে পানি ওভার ফ্লো করে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের জানান, তার আওতাধীন পোল্ডারে প্রায় ১৫কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া গাবুরাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে। এলাকায় আমাদের লোক রয়েছে। আমরা সঠিক তথ্য নেয়ার চেষ্টা করছি। বিস্তারিত পরে জানাতে পারবো।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলাম বাপ্পি জানান, ভরা পূর্ণিমার সাথে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপকূলে নদ-নদীতে ৪ ফুট পর্যন্ত পানি বেড়েছে। নদ-নদী উত্তাল রয়েছে। এতে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাউনিয়া, সুভদ্রাকাটি, রুইয়ারবিল, দিঘলারাইট ও হরিষখালী পয়েন্টে বাঁধ ভেঙ্গে যায়। এছাড়া পদ্মপুকুর ইউনিয়নে দু’টি পয়েন্টে ভেঙ্গে গেছে। এছাড়া উপকূলীয় এলাকার আরও বেশ কয়েকটি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ছাপিয়ে পানি লোকালয়ে প্রবশে করছে। প্রতাপনগর ও পদ্মপুকুর ইউনিয়নের ভাঙ্গন পয়েন্টে আমাদের লোক রয়েছে। নদীতে ভাটা হলে তারা বাঁধ মেরামতের কাজ শুরু করবে।
খুলনা গেজেট/এনএম/কেএম