প্রাকৃতিক দুর্যোগে সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা। প্রায় প্রতি বছর কোন কোন ঘূর্ণিঝড় উপকূলের বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে এলাকা প্লাবিত হয়। যে কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগে বেড়িবাঁধ ভাঙা যেন এই এলাকার নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। এভাবে বার বার বেড়িবাঁধ ভেঙে নদীর পানিতে প্লাবিত হওয়ায় অনেকে বসতভিটা হারিয়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। ফলে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবর পেলে বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবনের আতঙ্কে থাকে উপকূলবাসী। তাই সাতক্ষীরার উপকূলের মানুষের একটাই দাবি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিজেদের জানমাল রক্ষায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ।
আগামী ১ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট পেশ করবেন। তাই অগামী অর্থবছরের বাজেটে সাতক্ষীরার উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নাভারণ-সাতক্ষীরা-মুন্সিগঞ্জ রেললাইন প্রকল্প, জেলার কালিগঞ্জের বসন্তপুর নৌ-বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সাতক্ষীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন, ক্রীড়া কমপ্লেক্স স্থাপনসহ প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য বিশেষ বরাদ্দের দাবি সাতক্ষীরাবাসীর।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব অ্যাড. আবুল কালাম আজাদ বলেন, সারা দেশে উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এপারের জেলাগুলোতেও উন্নয়নের জোয়ার বইতে শুরু করেছে। কিন্তু সেই উন্নয়নের ঢেউ যশোর-নড়াইল-খুলনা-বাগেরহাট পর্যন্ত এসে পৌঁছুলেও সাতক্ষীরা জেলা বঞ্চিত রয়েছে। সাতক্ষীরা জেলার উন্নয়নের গতি খুবই ধীর। প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত এই এলাকায় শিক্ষার হার কম। প্রতি বছর নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপকূলের বেড়িবাঁধ। এতে করে সহায় সম্বল হারিয়ে নি:স্ব হয় অনেক মানুষ।
তিনি বলেন, দারিদ্রতার হার দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে মৌলবাদ জঙ্গিবাদসহ নানা সংকটে জর্জরিত এই এলাকা। ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে এই এলাকাকে এগিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। সাতক্ষীরার উন্নয়নে সরকার ইতিমধ্যে যুগান্তরকারী বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু সেগুলোর দৃশ্যমান অগ্রগতি খুবই কম। সাতক্ষীরার সার্বিক উন্নয়নে আগামী অর্থবছরের বাজেটে উপকূলীয় এই জেলার জন্য বিশেষ বরাদ্দের দাবি জানান তিনি।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক আন্দোলন মঞ্চের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী আলী সুজয় বলেন, সাতক্ষীরা মানেই সুন্দরবন। সাতক্ষীরার আকর্ষণ সড়ক পথে সুন্দরবন। একই সঙ্গে সাতক্ষীরায় বয়ে চলা যমুনা, বেতনা, মরিচ্চাপ, ইছামতি নদীর চরে বেশ কিছু সৌন্দির্যমন্ডত জায়গা রয়েছে। প্রতিটি জায়গাই ভ্রমণপিপাসুদের জন্য আকর্ষণীয়।
তিনি বলেন, তবে সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এই পর্যটনকেন্দ্রগুলো আমাদের তেমন কোনো কাজে আসছে না। যাতায়তব্যবস্থা ও অবকাঠামোর উন্নয়ন হলেই এখানের পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন সম্ভব। গোটা জেলার পর্যটন স্পটগুলো নিয়ে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হবে, এই বাজেটে আমাদের প্রত্যাশা এটাই।
সাতক্ষীরা জলবায়ু পরিষদের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী বলেন, বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়েই সাতক্ষীরাবাসী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জানমালের পাশাপাশি আমাদের কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ কারণে আমরা অবশ্যই দাবি করব আমাদের কৃষি বাঁচাতে সরকারের বাজেটে উপকূলীয় এ জেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ টেকসই করা হোক।
তিনি বলেন, দেশের কৃষি ও মৎস্য খাতে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে উপকূলীয় এই জেলাটি। এখানকার মৎস চাষীরা বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার কৃষিপণ্য উৎপাদন করে। গোটা দেশের চাহিদার প্রায় ৩০ ভাগ মাছের জোগান দেয়া হয় এই জেলা থেকে। তাই কৃষি ও মৎস্যজীবী মানুষগুলোকে নিরাপদে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষম টেকসই বেড়িবাঁধ ও অবকাঠামো নির্মাণ সবার আগে প্রয়োজন। তাই নতুন বাজেটে সরকার সেদিকে নজর দেবে বলে আশাবাদী এই নাগরিক নেতা।
এদিকে আসন্ন জাতীয় বাজেটে সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দের দাবিতে ২৪ মে বুধবার সাতক্ষীরা-২ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর মোস্তাক আহমেদ রবির সাথে সাক্ষাৎ করে দাবি দাওয়া সম্বলিত একটি স্মারকলিপি দিয়েছে জেলা নাগরিক কমিটি।
স্মারকলিপিতে ১৯ মে ২০২৩ বিশ্ব ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনের উদ্বৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ’ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উপকূলীয় এলাকা থেকে ৯৮ লাখ মানুষ তাদের বাড়িঘর ধ্বংস হওয়ায় ঢাকা শহরে যেতে বাধ্য হয়েছে। এর প্রভাবে সুন্দরবনের অস্বিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। অনেক পরিবারের ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হচ্ছে। দারিদ্র্য বাড়ছে। স্মারকলিপিতে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া এই এলাকাকে এগিয়ে নিতে ইতিমধ্যে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে অধিকাংশ উন্নয়ন টেকসই হচ্ছে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
স্মারকলিপিতে দেশের চলমান উন্নয়নের স্রোতধারায় এই এলাকাকে যুক্ত করতে নাভারণ থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত ব্রডগেজ রেল লাইন নির্মাণ এবং সাতক্ষীরা থেকে মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত ব্রডগেজ রেল লাইন নির্মাণ’ প্রকল্প বাস্তবায়ন, উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ,বসন্তপুর নৌবন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু, আগামী শিক্ষা বর্ষে সাতক্ষীরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু, সাতক্ষীরা অর্থনৈতিক অঞ্চল ও সাতক্ষীরায় আন্তর্জাতিক মানের একটি ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণের সরকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়।
খুলনা গেজেট/ এসজেড