সাতক্ষীরার প্রাণ প্রাণসায়ের খাল। খালের দূষণ রোধকল্পে জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও পৌরসভা যৌথভাবে কার্যক্রম গ্রহণ করায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে সাতক্ষীরার ঐতিহ্যবাহী প্রাণসায়ের খাল। বদ্ধ প্রাণ সায়ের খালে এখন বইছে পানির প্রবাহ। কিছুটা হলেও পরিবেশ ফিরে এসেছে খালের দুইপাড়ে। খালপাড়ের রাস্তা দিয়ে এখন নির্বিঘ্নে চলাচল করছেন পৌরবাসী।
সাতক্ষীরা জেলার পৌর এলাকার প্রাণ কেন্দ্রে ১৮৬৫ সালে তৎকালিন জমিদার প্রাণনাথ রায় চৌধুরী শহরের পানি নিষ্কাশন এবং নৌ-চলাচলের জন্য এল্লারচর নামক স্থান হতে একটি খাল খনন শুরু করেন। যা সাতক্ষীরা সদরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মরিচ্চাপ নদী এবং নৌখালি খালকে সংযুক্ত করেছে। খালটির আনুমানিক দৈর্ঘ্য প্রায় ১৩ কিলোমিটার ও প্রস্থ প্রায় ২০০ মিটার। পরবর্তীতে জমিদার প্রাণনাথ রায় চৌধুরী নামেই খালটির নাম হয় প্রাণসায়ের খাল।
সাতক্ষীরা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক সরদার সরিফুল ইসলাম বলেন, খালটির পাড়ে বা নিকটবর্তী স্থানে কোন ভারী শিল্প-কারখানা না থাকলেও প্রাণসায়ের খাল দখল ও দূষণে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। পৌর শহরের ময়লা-আবর্জনা ফেলার একটি বিশেষ স্থানে পরিণত হয়েছিল খালটি। খালটিতে পানি নিষ্কাশনের সঠিক ব্যবস্থা না থাকায় পৌর শহরের বিভিন্ন জায়গায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। খালটিতে বায়োলজিক্যাল, কেমিক্যাল এরুপ সকল ধরণের বর্জ্য ফেলার ফলে পানির বাস্ততন্ত্র নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগ জীবাণু ছড়ানোসহ মানুষ ও বিভিন্ন প্রাণী সংক্রমিত হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, শহরের বাসাবাড়ী হতে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রকার ধোঁয়া মোছার পানি ও পয়ঃবর্জ্য সরাসরি বিভিন্ন ড্রেন হয়ে খালে এসে পড়ছে। খালটির দুটি মুখ বন্ধ থাকায় অর্থাৎ পানির প্রবাহ না থাকায় এ দূষণ পরিস্থিতি আরো তরান্বিত হতে থাকে। সাতক্ষীরা শহরে কোন কসাইখানা না থাকায় প্রতিদিন শহরের সুলতানপুর বড় বাজারের সকল গরু-ছাগলের উচ্ছিষ্ট বর্জ্য সরাসরি খালে ফেলা হচ্ছে, যা দূষণের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। শহরের কিছু কিছু রেষ্টুরেন্ট এবং মিষ্টির কারখানার তরল বর্জ্য এবং ধোঁয়ামোছার পানি বিভিন্ন ড্রেন হয়ে খালে পতিত হচ্ছে। সাতক্ষীরা শহরে বড় বাজার ও সুলতানপুর কাঁচা বাজারে একটি মাত্র ডাষ্টবিন থাকায় পচনশীল এবং অপচনশীল বর্জ্য একটি বড় অংশ খালে ফেলা হচ্ছিল। খালের দক্ষিণ প্রান্ত কচুরিপানায় পূর্ণ হয়ে থাকাতে পানিতে সুর্যের আলো পৌছাতে না পারায় পানির বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হচ্ছিল। খালটির দেকভাল করার সংস্থা হিসাবে পানি উন্নয় বোর্ড এবং পৌরসভার মতপার্থক্যের কারণে দূষণ পরিস্থিতি আরো তরান্বিত হচ্ছে।
সরদার সরিফুল ইসলাম বলেন, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের আইন-শৃঙ্খলা সভায় গত চার বছরে বহুবার প্রাণসায়ের খাল দূষণের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হলেও কোন কাজ হচ্ছিল না। গত এপ্রিলে জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় পরিবেশ অধিদপ্তর, সাতক্ষীরা জেলা কার্যালয়ের প্রস্তাব মতে প্রাণসায়ের খালের দূষণ রোধকল্পে একটি যৌথ কমিটি গঠণ করা হয়। উক্ত কমিটিতে পরিবেশ অধিদপ্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কমিটির পক্ষ্য হতে দূষণ রোধকল্পে বিভিন্ন ধরনের প্রচার-প্রচারণাসহ সাইনবোর্ড স্থাপনের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। প্রাণসায়ের খাল সংলগ্ন সুলতানপুর বড় বাজারের (মাছ বাজার, কাঁচা বাজার, মাংসের বাজার) ইত্যাদি বণিক সমিতির সাথে একাধিক বার বৈঠক করে উক্ত বাজার ময়লা-আবর্জনা খালে না ফেলার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয় এবং তাদের সহযোগিতায় উক্ত খালে ময়লা-আর্বজনা অপসারণ করা হয়েছে।
খালের দুই পাড়ের ব্যবসায়ী এবং অধিবাসীদের খালে ময়লা না ফেলার জন্য মাইকিং করা হয়েছে। যারা শুনছে না তাদের সনাক্ত করে নোটিশ করা হচ্ছে। খালের দুই প্রান্তে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক বন্ধ করে রাখা হয়েছিল, যা জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সম্মতিক্রমে স্থানীয় অধিবাসী সহায়তায় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড এর সহোযোগিতায় বাঁধ অপসারণ করে খালে জোয়ার ভাটা বা প্রবাহ সৃষ্টি করা হয়েছে। খালের দুই পাড়ে বাসা-বাড়ির ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য পর্যাপ্ত ডাষ্টবিন স্থাপনের জন্য সাতক্ষীরা পৌরসভাকে অনুরোধ করা হয়েছে এবং ফাঁকা জায়গায় সুন্দরবন ফাউন্ডেশন (এনজিও) নামক সংস্থার মাধ্যমে কিছু বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। বর্তমানে খালটির অবস্থা পূর্বের চেয়ে অনেক ভালো হওয়ায় সাতক্ষীরা জেলা শহরে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন এবং পৌরসভার ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি আরো বলেন, খালটি রক্ষার জন্য গৃহিত কার্যক্রম যথেষ্ট নয়। খালটি রক্ষার জন্য আরো বেশ কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করা প্র্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে সাতক্ষীরা পৌরসভার কোন নিদিষ্ট আধুনিক কসাইখানা নাই। এজন্য পৌরসভার কর্তৃক শহরের বাইরে বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা সহ আধুনিক কসাইখানা স্থাপন করতে হবে। খাল পাড়ের এলাকা এবং সুলতানপুর বড় বাজারে পর্যাপ্ত ডাষ্টবিন স্থাপন করতে হবে এবং পৌরসভার কর্তৃক উক্ত ডাষ্টবিন হতে নিয়মিত ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করতে হবে। খালপাড়ে পর্যাপ্ত গাছ লাগানো সহ ওয়াকওয়ে নির্মাণ করতে হবে। তাহলে প্রাণসায়ের খালের সৌন্দর্য্য আরো বৃদ্ধি পাবে।
খুলনা গেজেট/এনএম