আসন সমঝোতা না হওয়ায় সাতক্ষীরার চারটি সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের সাথে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চলে এসেছে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। সাতক্ষীরার পুরাতন দুর্গো উদ্ধারের এবার মরিয়া তারা। তবে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলার চারটির মধ্যে কমপক্ষে দু’টি আসন পাওয়ার আশা করছেন জাপা দলীয় নেতা ও কর্মী সমর্থকরা।
বিগত ২০০৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের শরীক হিসেবে জেলার চারটি আসনের দুটিতে জয় পায় জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। সে সময় সাতক্ষীরায় জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থান বেশ শক্ত ছিল। শুধুমাত্র জাপার সাথে জোট হওয়ার কারণে ২০০৯ এর নির্বাচনে জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত সাতক্ষীরা চারটি আসনেই মহাজোট প্রার্থীরা বিজয় অর্জন করে বলে মনে করেন জাপা নেতাকর্মীরা। কিন্তু পরবর্তী দুটি নির্বাচনে মহাজোটের শরীক হয়েও সেই আসন আর ফিরে পায়নি দলটি। এছাড়া ২০১৪ সালের নির্বাচনের পূর্বের দুটি আসন মহাজোট জাতীয় পাটির প্রার্থীদের ছেড়ে দিলেও তারা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়। তবে এবার আ’লীগের সাথে আসন ভাগাভাগি না হওয়ায় পৃথকভাবে নির্বাচন করতে হচ্ছে দলটির। সেক্ষেত্রে জেলার চারটি আসনের মধ্যে কমপক্ষে দুটি আসন ফিরে পাওয়ার আশা নিয়ে মাঠে নামছেন দলের নেতা কর্মীরা। সেই লক্ষ্যে চারটি আসনেই আ’লীগের প্রার্থীদের সাথে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকছেন জাপা প্রার্থী ।
বিগত কয়েকটি নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করে জানা যায়, ৯০ এর গণঅর্ভ্যথানে জাতীয় পার্টি ক্ষমতা হারানোর পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনে জামায়াত প্রার্থী আনসার আলী নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিল চতুর্থ স্থানে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সৈয়দ কামাল বখত নির্বাচিত হন। এখানে তৃতীয় স্থানে ছিল জাতীয় পার্টির সৈয়দ দিদার বখত। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির হাবিবুল ইসলাম হাবিব নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী শেখ আলতাফ মাহামুদ ছিলেন চতুর্থ স্থানে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আসনটিতে মহাজোটের প্রার্থী শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির কোন প্রার্থী ছিলো না। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও এখানে জাতীয় পার্টির কোন প্রার্থী ছিলেন না। মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে ওয়ার্কার্স পার্টির মুস্তফা লুৎফুল্লাহ বিজয়ী হন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনেও মুস্তফা লুৎফুল্লাহ নির্বাচিত হন।
এদিকে সাতক্ষীরা-২ (সদর) আসনে ৯১-এর নির্বাচনে জামায়াতের কাজী সামছুর রহমান বিজয়ী হন। জাতীয় পার্টির প্রার্থী হাবিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয় স্থানে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জামায়াতের কাজী সামছুর রহমান জয়লাভ করেন। জাতীয় পার্টির প্রার্থী সৈয়দা রাজিয়া ফয়েজ ছিলেন ২য় স্থানে। ২০০১ সালে জামায়াতের আব্দূল খালেক মন্ডল নির্বাচিত হন। তৃতীয় স্থানে ছিলেন জাতীয় পার্টির সৈয়দা রাজিয়া ফয়েজ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে সদর আসনে মহজোটের প্রার্থী জাতীয় পাটির এমএ জব্বার নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের আ’লীগের দলীয় প্রার্থী মীর মোস্তাক আহমেদ নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে জাপা প্রার্থী তার মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করে নেন বলে জানা যায়। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও সদরে জাতীয় পাটির কোন প্রার্থী ছিল না।
সাতক্ষীরা-৩ (আশাশুনি) আসনে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জামায়াতের রিয়াছাত আলী নির্বাচিত হন। জাতীয় পার্টির স. ম. সালাউদ্দিন ছিলেন তৃতীয় স্থানে। ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগের এসএম মোখলেছুর রহমান নির্বাচিত হন। এসময় জাতীয় পার্টির এসএম সালাউদ্দিন দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। ২০০১ এর নির্বাচনে জামায়াতের রিয়াছাত আলী পুনরায় নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে তৃতীয় স্থানে ছিলেন জাতীয় পার্টির স. ম. সালাউদ্দিন।
পরবর্তী ২০০৮ সালের নির্বাচনে আসনটির সাথে দেবহাটা উপজেলা ও কালিগঞ্জের ৪টি ইউনিয়ন যুক্ত করা হয়। এই নির্বাচনে আ’লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থী আ.ফ.ম. ডাঃ রুহুল হক নির্বাচিত হন। এছাড়া ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনেও মহাজোটের প্রার্থী হিসাবে ডাঃ রুহুল হক এই আসনে নির্বাচিত হন। দেবহাটা ও কালিগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত সাবেক সাতক্ষীরা-৪ আসনে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আ’ লীগের মুনসুর আহমেদ নির্বাচিত হন। জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিলেন চতৃর্থ স্থানে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে সাবেক সাতক্ষীরা-৪ (দেবহাটা-কালিগঞ্জ) আসনে জাতীয় পার্টির শাহাদাত হোসেন নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের মুনসুর আহমেদ ছিলেন দ্বিতীয় স্থানে। সাবেক এই আসনে ২০০১ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি (নাফি) প্রার্থী কাজী আলাউদ্দিন বিজয়ী হন। দ্বিতীয় স্থানে ছিলে আওয়ামী লীগের আ. ফ. ম. ডাঃ রুহুল হক।
বর্তমান সাতক্ষীরা-৪ আসনে (শ্যামনগর-কালিগঞ্জের আংশিক) ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী জাতীয় পার্টির এইচএম গোলাম রেজা নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের এই আসনে জাতীয় পাটির প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেয়। নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের এসএম জগলুল হায়দার। পরবর্তী ২০১৮ সালের নির্বাচনেও এসনএম জগলুল হায়দার বিজয়ী হন।
শুধুমাত্র শ্যামনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত সাবেক সাতক্ষীরা-৫ আসনে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জামায়াতের গাজী নজরুল ইসলাম নির্বাচিত হন। এসময় জাতীয় পার্টির আব্দুল হামিদ ছিলেন তৃতীয় স্থানে। সাবেক সাতক্ষীরা-৫ আসনে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একে ফজলুল হক নির্বাচিত হন। এখানে তৃতীয় স্থানে ছিল জাতীয় পার্টির আবুল হোসেন।
সাতক্ষীরা জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি শেখ আজাহার হোসেন বলেন, পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন বলে নব্বই এর ‘তথাকথিত’ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে লেভেল পে¬য়িং ফিল্ড তৈরী করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। কিন্তু সেই সরকার জাতীয় পার্টিকে মাঠ ছাড়া করার চেষ্টা করে। তারপরও জাতীয় পার্টি ঘুরে দাঁড়ায় এবং পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে ভালো ফল করে।
তিনি আরও বলেন, জামায়াত অধ্যুষিত সাতক্ষীরায় ২০০৮ সালের সকল দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মহাজোটের ব্যাপক বিজয় সম্ভব হয়েছিল জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের ভোট একত্রিত হওয়ার কারণে। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে কেন্দ্রের নির্দেশে পার্টির প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়।
শেখ আজাহার হোসেন আরো বলেন, সাতক্ষীরার সবকটি আসনে জাতীয় পাটির প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। সাতক্ষীরা-১ আসনে সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ দিদার বখত বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন। ওই এলাকার উন্নয়ন তার হাত ধরেই শুরু হয়েছে। সাতক্ষীরা-২ আসনে দলের জেলা সাধারণ সম্পাদক আশরাফুজ্জামান আশু একজন শক্তিশালী প্রার্থী। নির্বাচনে তিনিই বিজয়ী হবেন দাবী জানিয়ে তিনি বলেন, জনগণ বিকল্প চাচ্ছে। সাতক্ষীরা-৩ আসনে প্রার্থী নবীন হলেও তার পারিবারিক ঐতিহ্য আছে। জনগন স.ম. আলিফ হোসেনের পরিবারকে চেনে। যেকারণ এ আসনেও জাতীয় পাটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। সাতক্ষীরা-৪ আসনে দুইবারের নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান মাহাবুবর রহমান ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। তারও জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
খুলনা গেজেট/এনএম