সাতক্ষীরা জজশীপ ও বিচারিক হাকিম আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর ও সরকারি কৌশুলীগণ দায়িত্ব পালন করছেন না। ফলে নির্ধারিত দিনে আদালতে এসেও ফিরে যাচ্ছেন পুলিশ, বিজিবি ও ডাক্তারসহ বিভিন্ন মামলার সরকারি সাক্ষীরা। এতে করে হত্যা, ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন, নাশকতা, ডাকাতি ও এসিড বার্নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিচারাধীন মামলার কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার পর ৬ আগষ্ট থেকে আদালতে এই অচালবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বিলম্বিত হচ্ছে গুরুত্বপূর্ন মামলা নিষ্পত্তির কার্যক্রম।
সাতক্ষীরা আদালত সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরায় জেলা ও দায়রা জজ, পাঁচটি অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, দুটি যুগ্ম জেলা জজ, একটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, আটটি সহকারি জেলা জজ, একটি ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল ও আটটি আমলী আদালত রয়েছে। এসব আদালতের বিচারিক কার্যক্রম চালানোর জন্য একজন পিপি ও একজন সরকারি কৌশুলীসহ (জিপি) ৪২জন অতিরিক্ত পিপি, সহকারি পিপি, অতিরিক্ত সরকারি কৌশুলী ও সহকারি কৌশুলী রয়েছেন। ২০১৮ সালে সংসদীয় নির্বাচনের কয়েক মাস পর থেকে পিপি হিসেবে অ্যাড. আব্দুল লতিফ ও সরকারি কৌশুলী (জিপি) হিসেবে এড. শম্ভুনাথ সিংহ নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
সাতক্ষীরা জজ কোর্টের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জানান, বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। এ ঘটনার পরদিন থেকে নিজ নিজ আদালতে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের বেশ কয়েকজন আইনজীবী বিশেষ কয়েকজন আইনজীবীর কাছে লাঞ্ছিত হন। আবার অনেকেই পরিস্থিতি প্রতিকূল হওয়ায় আদালতে দায়িত্ব পালন করতে যাননি। অনেকেই আবার আদালতে আসেননি। পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় এখনো তারা আদালতে এসে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন না।
সাতক্ষীরা জজ কোর্টের আইনজীবী এড. আলী হোসেন জানান. শ্যামনগর উপজেলার নৈকাটি গ্রামের ময়না খাতুনকে শ্বাসরোধ করে হত্যার ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতে বিচারাধীন সেশন-২৫৪/০৬ মামলাটির সাক্ষীর জন্য ১৯ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য ছিল। একইভাবে শ্যামনগর উপজেলার ভুরুলিয়া গ্রামের মৃণাল মন্ডল হত্যা মামলাটি (সেশন-২৪২/০৬) সাক্ষীর জন্য গত ২০ আগস্ট দিন ধার্য ছিল। সংশ্লিষ্ট অতিরিক্ত পিপি এড. আতাউর রহমান ও অ্যাড. খোদাবক্স রাষ্ট্রপক্ষে দায়িত্ব পালন না করায় সাক্ষীর দিন পিছিয়ে যায়। পরবর্তী দিন পড়েছে ২৮ অক্টোবর।
সাতক্ষীরা জজ কোর্টের আইনজীবী এড. জিয়াউর রহমান জিয়া ও এড. অসীম কুমার মন্ডল জানান, দেবহাটা উপজেলার বেজোরাটি গ্রামের তাসলিমা খাতুন হত্যা মামলা (সেশন-৪৯৯/২২)ও আশাশুনির কোদন্ডা গ্রামের শাহীদা খাতুন হত্যা মামলা (সেশন-১৬১৭/১৯) দুটি অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ২য় আদালতে বিচারাধীন। উচ্চ আদালত ওই দুটি মামলা ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির জন্য নির্দেশ দেন গত বছরের নভেম্বর মাসে। গত ১০ সেপ্টেম্বর ওই মামলার ধার্য্য দিন ছিল। পরবর্তী দিন ধার্য হয়েছে ২৯ সেপ্টেম্বর। একই আদালতে আশাশুনির রামনগর গ্রামের হাফেজ কবিরুল হত্যা মামলার সেশন-৫৪/২০০৩) যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য গত ১২ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য ছিল। সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পিপি অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু ও অ্যাড. রুহুল আমিন ধার্য দিনে দায়িত্ব পালন না করায় মামলার কার্যক্রম চলেনি।
এ ছাড়া অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ৫ম আদালতে অতিরিক্ত পিপি অ্যাপ.তপন কুমার দাস ও আব্দুল বারি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি এড. এসএম জহুরুল হায়দার বাবু দায়িত্ব পালন না করায় এসব আদালতের মামলার বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। একইভাবে দুর্নীতি দমন কমিশন ট্রাইব্যুনালেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। একই সাথে অর্পিত সম্পত্তি ও খাস জমি সংক্রান্ত মামলা, বিচারিক হাকিম আদালতের মামলায় অতিরিক্ত পিপি, সহকারি পিপিসহ সরকারি কৌশুলীরা দায়িত্ব পালন না করায় মামলার বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে অতিরিক্ত পিপি এড. আতাউর রহমান জানান, গত ৬ আগস্ট থেকে পাবলিক প্রসিকিউটর এড. আব্দুল লতিফ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের দায়িত্ব পালন করার জন্য একটি চিঠি তাকে দিয়ে যান। কিন্তু কতিপয় আইনজীবী বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তাকে দায়িত্ব পালন না করার ব্যপারে সংশ্লিষ্ট বিচারক মহোদয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ঝামেলা এড়াতে তাই তিনি দায়িত্ব পালন করছেন না।
অতিরিক্ত পিপি এড. ফাহিমুল হক কিসলু, এড. সৈয়দ জিয়াউর রহমান, এড. আলী হোসেন, সরকারি কৌশুলী এড. শম্ভুনাথ সিংহসহ কয়েকজন জানান, অর্ন্তবর্তী সরকারের নতুন পিপি ও জিপি তালিকা না আসা পর্যন্ত তাদের দায়িত্ব পালনে কোন বাঁধা নেই। সাতক্ষীরা ছাড়া দেশের অন্য জেলা গুলোতে তাদের সময়কার নিয়োগকৃত পিপি ও জিপিরা দায়িত্ব পালন করলেও সাতক্ষীরায় স্বাচ্ছন্দ বোধ না করায় তারা দায়িত্ব পালন করছেন না। এতে বিচারপ্রার্থীরা অসুবিধায় পড়লেও তাদের কিছু করার নেই।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা জেলা আইনজীবী সমিতির আহবায়ক এড. জিএম লুৎফর রহমান বলেন, পিপি ও জিপিগণ সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত। তাদের দায়িত্ব পালন না করার জন্য কোন চিঠি না এলে তাদের কাজ করতে কোন বাাঁধা নেই। তবে সাতক্ষীরার পিপি ও জিপিগণ স্বাচ্ছন্দ বোধ না করায় তারা দায়িত্ব পালন করছেন না। এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। তবে আগামী রোববার থেকে সরকারিভাবে নতুন তালিকা আসতে পারে এমন সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, তারপর থেকে এই জটিলতা কাটিয়ে উঠে বিচারিক কার্যক্রম ত্বরান্বিত হবে।
খুলনা গেজেট/এনএম