খুলনা, বাংলাদেশ | ২ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১৭ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  দুর্নীতি ও আমলাতন্ত্র দেশে ব্যবসায় পরিবেশ নিশ্চিতের অন্যতম বাধা : সিপিডি
  সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন ও তার স্বামীর পাসপোর্টের আবেদন স্থগিত
  দেশ টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গ্রেপ্তার

সাতক্ষীরায় ছয় মাসে ১১ শিক্ষার্থীসহ ২৪ জনের আত্মহত্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা

সাতক্ষীরায় দিন দিন বাড়ছে আত্মহননের ঘটনা। গত ৬ মাসে জেলায় ১১ শিক্ষার্থীসহ কমপক্ষে ২৪ জন আত্মহত্যা করেছে। আত্মহননকারি এসব শিক্ষার্থীদের বয়স ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। এছাড়া ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি রয়েছেন ৩ জন। এদের মধ্যে কালিগঞ্জ উপজেলায় সর্বাধিক ৯ জন আত্মহত্যা করে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪ জন অত্মহত্যা করে শ্যামনগর উপজেলায়। পারিবারিক অশান্তি, অর্থনৈতিক সংকট, প্রেমে ব্যর্থসহ বিভিন্ন কারণে জেলায় আত্মহননের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে সমাজবিদদের ধারণা।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত জুন মাসে জেলায় অন্তত ১১টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। এর আগে মে মাসে ৫ জন, এপ্রিল মাসে ৩ জন, মার্চ মাসে একজন, ফেব্রুয়ারি মাসে ৩ জন এবং জানুয়ারি মাসে একজন আত্মহত্যা করেন। আত্মহননকারীদের একটি বড় অংশ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। এছাড়া পারিবারিক অশান্তির কারণেও স্বেচ্ছামৃত্যুবরণ করেছেন অনেকেই।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, পহেলা জুন সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি বেড়াতে এসে আত্মহত্যা করেন কালিকাপুর মধ্যপাড়ার আব্দুল মালেকের মেয়ে ও পার্শ্ববর্তী রামনগর গ্রামের মনিরুজ্জামানের স্ত্রী পারভীন সুলতানা (৩৪)। একই দিন আত্মহত্যা করেন আশাশুনি উপজেলার দক্ষিণ খাজরা গ্রামের বেলাল হোসেনের মেয়ে জরিনা খাতুন (১৫)। গত ১০ জুন শ্যামনগরের জয়াখালী গ্রামের আব্দুল কাদের গাজীর মেয়ে ও স্থানীয় ভেটখালী এ.করিম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্রী খাজুরী সুলতানা জুই (১৭)। উপজেলা তারানীপুর গ্রামে তার নানার বাড়িতে এসে আত্মহত্যা করে। একই দিনে কালিগঞ্জের পানিয়া গ্রামের নূর ইসলামের মেয়ে মৌসুমী পারভীন (১৭) আত্মহত্যা করে। সে চলতি বছর এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। ১৫ জুন তালায় প্রেমিকের উপর অভিমান করে প্রিয়াঙ্কা সরকার (১৯) নামক এক কলেজ ছাত্রী আত্মহত্যা করেন। সে তালা উপজেলার হাতবাস গ্রামের মিঠুন সরকারের মেয়ে। ২০ জুন কলারোয়া উপজেলার কেঁড়াগাছি গ্রামের মোটরসাইকেল চালক আলমগীর হোসেনের মেয়ে রিয়া আক্তার (১৭)। ২১ জুন দেবহাটা উপজেলার বহেরা গ্রামের আব্দুল মজিদ গাজীর ছেলে আব্দুস সালাম (৩০), ২৪ জুন পাটকেলঘাটা থানার মির্জাপুর এলাকার কার্তিক ঘোষের মেয়ে ও মির্জাপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী অমৃতা ঘোষ (১৫), ২৬জুন শ্যামনগর উপজেলার চকবারা গ্রামের আকছেদ আলী গাজীর ছেলে মনিরুল ইসলাম বাবু (২৫), ২৯ জুন গাবুরায় ৯নং সোরা গ্রামের মুনছুর মালির ছেলে হাসান মালী (৩০) আত্মহত্যা করে।

এছাড়া গত ৩০ জুন সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে বৃষ্টি মন্ডল (১৪) নামে ৮ম শ্রেণির এক ছাত্রী বিষপানের ২৫দিন পর মারা যায়। সে উপজেলার মৌতলা ইউনিয়নের লক্ষ্মীনাথপুর গ্রামের বিশ্বজিৎ মন্ডলের মেয়ে। বৃষ্টি মন্ডল দক্ষিণ শ্রীপুর কুশলিয়া উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী ছিল।

এদিকে মে মাসে সাতক্ষীরায় অন্তত ৫টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। সূত্র জানায়, ৩ মে আশাশুনি উপজেলা বুধহাটা ইউনিয়নের বৃদ্ধ নুরু শেখ (৬৫) আত্মহত্যা করেন। ৫ মে কলারোয়ায় আমিরুল করিম (৭৪) নামের এক কৃষকের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ১৪ মে কালিগঞ্জের গোবিন্দপুর গ্রামের বিজন মন্ডলের স্ত্রী শিউলী বসাক (৩০), ১৬ মে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের দক্ষিণ বালাপোতা গ্রামের মৃত বাবুল উদ্দীনের ছেলে শ্রমিক মিজানুর রহমান (৬২) এবং ২৯ মে কালিগঞ্জের শীতলপুর গ্রামের হান্নান সরদারের মেয়ে সোহাগি আক্তার ওরফে হেনা (২০) নামের এক যুবতী আত্মহত্যা করেন।।

এপ্রিল মাসে সাতক্ষীরায় ৩ জনের আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়। সূত্রমতে, ১৪এপ্রিল সাতক্ষীরা শহরের কামালনগর এলাকার ইরানি আফরোজ তানু (২৭) নামের এক গৃহবধূ, ১৭ এপ্রিল শ্যামনগরে প্রেমিকার উপর অভিমান করে প্রদীপ কুমার মন্ডল (২৭) নামের এক যুবক, ২৪ এপ্রিল রাতে তালা উপজেলার খলিষখালী ইউনিয়নের বিশ্বেষকাটি গ্রামের সুকুমার মন্ডলের স্কুল পড়ুয়া মেয়ে লাবনী মন্ডল (১৬) বিষপানে আত্মহত্যা করেন।

মার্চ মাসে একজনের আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়। ১৮ মার্চ সাতক্ষীরা শহরতলীর ঝুটিতলায় আত্মহত্যার চেষ্টাকারী স্ত্রী রুপা খাতুনকে বাঁচিয়ে স্বামী সোহেল রানা (২৫) নিজে আত্মহত্যা করেন।

চলতি ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাতক্ষীরায় ৩ জন আত্মহত্যা করেন বলে খবর পাওয়া যায়। পহেলা ফেব্রুয়ারি দেবহাটায় দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী হেমা পারভীন (১৫), ৪ ফেব্রুয়ারি কালীগঞ্জে আবুল হাসান (২৮) নামের এক যুবক, ৬ ফেব্রুয়ারি তালায় নদী বিশ্বাস (১৪) নামের নবম শ্রেণীর এক ছাত্রী এবং ২৬ জানুয়ারি কালিগঞ্জে আল আমিন সরদার (২০) নামের এক কলেজ ছাত্র আত্মহত্যা করে।

সাতক্ষীরার বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও ‘নিজ অধিকার’ নামের একটি উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড. দিলীপ কুমার দেব বলেন, আত্মহত্যা প্রতিরোধে আশাহীন মানুষের মধ্যে আশা জোগাতে হবে। আত্মহত্যা প্রতিরোধযোগ্য। মানসিক রোগ সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি ও আগে থেকেই এগুলো চিহ্নিত করে চিকিৎসা দিলে আত্মহত্যা প্রতিরোধে সহায়ক হবে।

তিনি বলেন, আত্মহত্যার অন্যতম ঝুঁকি হচ্ছে-মেজর ডিপ্রেশন, মাদকাসক্তি, সিজোফ্রেনিয়া ও পূর্বে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে তেমন ব্যক্তিরা। অথচ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে তেমন ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমরা টিটকারি করি, অবহেলা বা অবজ্ঞা করি। প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে তারা আবেগীয় ও মানসিকভাবে অতি দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী। যারা একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে, পরবর্তী সময় আত্মহত্যা করার হার তাদের ছয় গুণ বেশি। তারা সামান্য কারণে ভেঙে পড়ে, হতাশ হয়, ক্ষুব্ধ হয় ও গ্লানিতে ভুগে। পরিবার ও স্কুলে তেমন ঝুঁকিপূর্ণ ছেলেমেয়েদের চিহ্নিত করতে হবে এবং তাদের আচরণ যত বিরক্তিকর, অসহ্য মনে হোক না কেন-ঘৃণা, অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য করে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করা ঠিক হবে না। বরং তাদের দরকার যত্ন, স্নেহ, সহায়তা ও প্রয়োজনে প্রফেশনাল কাউন্সেলিং।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এর সাতক্ষীরা জেলা কমিটির সদস্য সচিব এড. মুনিরুদ্দীন বলেন, আত্মহত্যার সংবাদ প্রচারে মিডিয়ার দায়িত্বশীলতা অনেক। কেননা, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ‘অনুকরণ’ করে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকে। যখন কোনো কিশোর-কিশোরীর আত্মহত্যার খবর প্রচারিত হতে দেখা যায়, তখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আবেগীয়ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ আরও অনেক কিশোর-কিশোরী একই পদ্ধতি ব্যবহার করে আত্মহত্যা করে বা চেষ্টা করে। তাই পত্রপত্রিকা ও টিভিতে দায়িত্বশীল ও সংবেদনশীল রিপোর্টিংয়ের জন্য ১০টি নীতিমালা ঠিক করা হয়েছে।

তিনি বলেন, সুইসাইড নোটের বিবরণী প্রকাশ করা যাবে না। অনুমান নির্ভর কারণ বা উসকে দেওয়া কাহিনি প্রচার করা যাবে না। কিশোর-কিশোরীদের আত্মহত্যা যেহেতু সংক্রামক, তাই তাদের আত্মহত্যার খবর বিশেষ সতর্কতার সাথে প্রকাশ করা উচিৎ।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!