আজ ৭ ডিসেম্বর। পাঞ্জাবি এসডিওকে গ্রেপ্তার আর পাকিস্তানী পতাকায় আগুন ও মাতৃভূমি বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উড্ডয়নের মধ্য দিয়ে দামাল ছেলেরা সাতক্ষীরাকে শত্রুমুক্ত করেছিল এদিন। নয়মাসের বীরোচিত লড়াইয়ে ১৬টি যুদ্ধ জয়ের পর এদিন সাতক্ষীরার মাটিতে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে আসতেই পিছু হটে যায় পাকি বাহিনী।
মুক্তিযোদ্ধারা ঘিরে ফেলে সাতক্ষীরার ডাক বাংলোয় ঘাঁটি করা পাক সেনাদের। বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহিত খান দুলুর নেতৃত্বে ধুলিহর বেজেরডাঙ্গা থেকে একটি দল এবং ক্যাপটেন হুদা ও আবদুল্লাহর নেতৃত্বে আরও দুটি মুক্তিযোদ্ধা দলের ত্রিমুখী আক্রমনের মুখে শত্রু বাহিনী বেনেরপোতা ও বেত্রাবতী ব্রিজ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে পিছু হটে যায়। বীর যোদ্ধারা সাতক্ষীরা থানা ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে ঘোষণা দেন সাতক্ষীরা মুক্ত দিবসের। নানা আয়োজন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে আজ পালিত হবে সাতক্ষীরামুক্ত দিবস।
১৯৭১ সালের এই দিনে সাতক্ষীরার দামাল ছেলেরা ভারতের সীমানা পেরিয়ে থ্রি নট থ্রি আরএসএলআরের ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সাতক্ষীরা শহরে প্রবেশ করে। ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলার লাল সবুজের পতাকা। সন্তান হারানোর বেদনা ভুলে সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সাথে রাস্তায় নেমে আসে মুক্তিপাগল আপামর জনতা। দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেদিনের সাহসী সস্তানরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। পাক হানাদার ও তাদের দোসররা মা-বোনের ইজ্জত হরণ করেছিল। ধ্বংস করতে চেয়েছিল বাঙ্গালীর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে। শত্রুর বুলেটের এত সব আঘাত সহ্য করেও সাতক্ষীরার সস্তানরা অন্তত: ৫০টি যুদ্ধের মোকাবেলা করেছিল।
জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ সাতক্ষীরা শহরে পাকিস্তান বিরোধী মিছিলে রাজাকাররা গুলি করে হত্যা করে শহীদ আব্দুর রাজ্জাককে। আর এখান থেকে শুরু হয় সাতক্ষীরার দামাল ছেলেদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া। মুক্তিযুদ্ধের খরচাদি বহনের জন্য সাতক্ষীরা ট্রেজারী হতে অস্ত্র আর ন্যাশনাল ব্যাংক হতে অপারেশনের মাধ্যমে অলংকার টাকা পয়সা নেওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় মুক্তির সংগ্রাম। ৮ম ও ৯ম সেক্টরের অধীনে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ট্রেনিং শেষে ২৭ মে সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। এ সময় পাক সেনাদের দু’শতাধিক সৈন্য নিহত হয়। ১৭ ঘণ্টাব্যাপী এ যুদ্ধে শহীদ হন তিন জন মুক্তিযোদ্ধা। আহত হন আরো দু’জন মুক্তিযোদ্ধা। এরপর থেমে থেমে চলতে থাকে সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্ত হামলা। এসব যুদ্ধের মধ্যে ভোমরার যুদ্ধ, টাউন শ্রীপুর যুদ্ধ, বৈকারী যুদ্ধ, খানজিয়া যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। এ সব যুদ্ধে শহীদ হয় ৩৩জন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
৬ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা ঘিরে ফেলে সাতক্ষীরার ডাকবাংলোয় ঘাঁটি করা পাক সেনাদের। বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহিত খান দুলুর নেতৃত্বে ধুলিহর বেজেরডাঙ্গা থেকে একটি দল এবং ক্যাপটেন হুদা ও আবদুল্লাহর নেতৃত্বে আরও দুটি মুক্তিযোদ্ধা দলের ত্রিমুখী আক্রমনের মুখে শত্রু বাহিনী টিকতে না পেরে বিনেরপোতা এলাকায় বেত্রাবতী নদীর ব্রীজ, বাঁকাল ও কদমতলা ব্রীজ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে পিছু হটে যায়। রাতেই পাক বাহিনী সাতক্ষীরা থেকে পালিয়ে যায়। ৭ ডিসেম্বর জয়ের উন্মাদনায় জ্বলে ওঠে সাতক্ষীরার দামাল ছেলেরা। বীর যোদ্ধারা শহরে ঢুকে সাতক্ষীরা থানা ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে ঘোষণা দেন সাতক্ষীরা মুক্ত দিবসের। সন্তান হারানোর বেদনা ভুলে সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সাথে রাস্তায় নেমে আসে মুক্তিপাগল আপামর জনতা।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে শত্রুদের গুলিতে সাতক্ষীরার যে সকল বীর সন্তান শহীদ হন তারা হলেন, শহীদ আব্দুর রাজ্জাক, কাজল, খোকন, নাজমুল, হাফিজউদ্দিন, নুর মোহাম্মদ, আবু বকর, ইমদাদুল হক, জাকারিয়া, শাহাদাত হোসেন, আব্দুর রহমান, আমিনউদ্দিন গাজী, আবুল কালাম আজাদ, সুশীল কুমার, লোকমান হোসেন, আব্দুল ওহাব, দাউদ আলী, সামছুদ্দোহা খান, মুনসুর আলী, রুহুল আমীন, জবেদ আলী, শেখ হারুন অর রশিদ প্রমুখ।
স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর আবারও নানা আয়োজন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে পালিত হবে সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ, স্বাধীনতার ৪৯ বছর পেরিয়ে গেলেও সাতক্ষীরার বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি আজও। একই সাথে সাতক্ষীরা কালেক্টরেট চত্বরে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নির্মিত শহীদ স্মৃতি স্তম্ভে ‘রাজাকার’ এর নাম থাকায় তা উদ্বোধন করা হয়নি।
খুলনা গেজেট/কেএম