‘সাংবাদিকতা’শব্দটি এসেছে সংবাদ থেকে, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ হল নিউজ এবং আরবী প্রতিশব্দ হল খবর, হাদিস, কিসসা বা নাবা। এই নাবা থেকেই নবি। নবি শব্দের অর্থ সংবাদদাতা, সংবাদবাহক বা দূত ইত্যাদি। এই অর্থে প্রত্যেক নবিকেই একেকজন সংবাদদাতা বা সাংবাদিক বলা যায়। পবিত্র কুরআনের ৩০ তম পারার প্রথম সূরাটির নাম ‘আন্নাবা’তথা সংবাদ।
ইসলামের দৃষ্টিতে সাংবদিকতার মূল বিষয় হলো, সমাজের প্রকৃত চিত্র বিশ্বস্ততার সাথে জনসম্মুখে তুলে ধরা। অসংগতি নিরসনকল্পে দায়িত্বশীলদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং সমাজের ভাল দিকগুলির কৃতজ্ঞতা স্বীকারের মাধ্যমে সৎকাজে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। এ প্রসঙ্গে ইসলামী শারীয়াহর বিষদ আলোচনা রয়েছে। নিন্মে ইসলামী সাংবাদিকতার ৫টি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি পবিত্র কুরআন থেকে তুলে ধরা হলো।
সংবাদ একটি আমানত
একজন আদর্শ সাংবাদিককে সর্বদা একথা স্মরণ রাখতে হবে যে, সংবাদ আমার কাছে একটি আমানত। পূর্ণ বিশ্বস্ততার সাথে তা জনসম্মুখে উপস্থাপন করা আমার একান্ত কর্তব্য। সুতরাং প্রতিটি তথ্য ও সংবাদকে বস্তুনিষ্ঠভাবে গণমাধ্যমে তুলে ধরতে হবে। এক্ষেত্রে নিজস্ব চিন্তা কিংবা নির্দিষ্ট দল-মতের রংচং মাখিয়ে সংবাদকে আংশিক বা পুরোপুরি পরিবর্তন করে উপস্থাপন করা কখনোই ইসলাম সমর্থিত নয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! আল্লহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো। (সুরা আহজাব- ৭০)
পূর্ণ নিশ্চয়তার সাথে সংবাদ প্রকাশ করা
সাংবাদিকগণ জনমানুষের আস্থার প্রতিক। সুতরাং তাদের আস্থা রক্ষার বিষয়টিও সংবাদকর্মীদের গুরুদায়িত্ব। এক্ষেত্রে সামান্য অবহেলা বড় ধরণের ক্ষতির কারণ হতে পারে। কেবল কিছু একটা শুনেই খবর প্রকাশ করে দেওয়া একজন আদর্শ সাংবাদিকের বৈশিষ্ট হতে পারে না। এক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের নির্দেশনা হলো, ‘হে মুমিনগণ, যদি কোনো পাপাচারী তোমাদের কাছে কোন বার্তা নিয়ে আসে, তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে। যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি সাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে যাতে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদের অনুতপ্ত হতে না হয়। (সুরা হুজরাত : ৬)
কিন্তু হালের কিছু মিডিয়া কর্মীর একটি তিক্ত বাস্তবতা হলো, সময়ের অপেক্ষা না করে বা খবরের শেষ না জেনেই কোন একটি খবর প্রচার করে দেয়া। অথবা সামান্য ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করেই অসম্পূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদ প্রচার করা। এটা একটি জঘন্য অপরাধ। মহান আল্লাহ বলেন, যে বিষয়ে তোমার জানা নেই সে প্রসঙ্গে কোন মতামত ব্যক্ত করো না। (সুরা বনি ইসরাইল-৩৬)
প্রিয় নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যা শুনবে, তা-ই (যাচাই বাছাই ছাড়া) বর্ণনা করা মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট- (মুসলিম-৭১১৪)
কারো মানহানির উদ্দেশ্যে সংবাদ প্রকাশ
নিছক কাউকে হেয় করার মানসে কারো এমন সংবাদ প্রকাশ করা জায়েজ নেই, যার দ্বারা অন্য কারো ক্ষতির সম্ভাবনা না থাকে। এটা বড় গুনাহ। তবে যদি অন্যের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে তবে তা প্রচারে কোন দোষ নেই। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ মন্দ কথার প্রচার-প্রসার পছন্দ করেন না, কিন্তু যার ওপর জুলুম করা হয়েছে (তার কথা ভিন্ন)- (সুরা নিসা : ১৪৮)
এছাড়া হাদিস শরিফে এসেছে, প্রিয় নবীজি সা. বলেন, ‘এক মুসলমানের জন্য অন্য মুসলমানকে মানহানি করা হারাম’- (তিরমিজি-১৯২৬)
পক্ষপাত ও সকল প্রকার প্রভাবমুক্ত সাংবাদিকতা
সাংবাদিকতা হলো জনতার জবান। সাধারণ মানুষের না বলা কথাগুলি প্রকাশের মাধ্যম হলো মিডিয়া। কিন্তু তা যদি হয় নানা স্বার্থে প্রভাবান্বিত তবে তা হবে উদর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে। সুতরাং একজন আদর্শ সাংবাদিককে থাকতে হবে সবধরণের স্বার্থের উর্ধে। কারো আশির্বাদের আশা বা রক্ত চক্ষুর ভয়ে সাংবাদিকতার এই অঙ্গন কুলুষিত করা যাবে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা সীমা লঙ্ঘন করেছে, তোমরা তাদের প্রতি ঝুঁকে পড়ো না; অন্যথায় জাহান্নামের আগুন তোমাদের স্পর্শ করবে’- (সুরা হুদ : ১১৩)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য উচ্চারণ করাই উত্তম জিহাদ’ (নাসায়ী-৪২২০)
শব্দচয়ন ও বাক্য ব্যবহারে সচেতনতা
পাঠকের দৃষ্টি নজর কাড়তে আকর্ষনীয় শিরোনামের বিকল্প নেই। অনুরূপ উপস্থাপনের ভাষায়ও যদি একটু রস না থেকে তবে কেমন যেন পানসে হয়ে যায়। মূলত সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে যথাপোযুক্ত শব্দচয়ন ও বাক্য ব্যবহারের গুরুত্ব অপরিসীম। একটি মাত্র শব্দ সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু এপিট ওপিট করে দিতে পারে। মনে রাখতে হবে, গণমাধ্যম কেবল ভাষাকে লালনই করে না; বহু নতুন নতুন শব্দেরও সৃষ্টি করে।
সুতরাং একজন আদর্শ সাংবাদিকের জন্য বিষয়টি খুব গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য রাখতে হবে। যদিও সাহিত্য ও সাংবাদিকতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি ছাড়া অপরটি নিষ্ক্রিয়। তথাপি এক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা হলো, যুগের ভাষা রপ্ত করে সঠিক ও প্রজ্ঞাপৃর্ণ শব্দ চয়ন করা। মহান আল্লাহ বলেন- ‘তুমি মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করো প্রজ্ঞা ও সদুপদেশের মাধ্যমে’- (সুরা নাহল : ১২৫)
(লেখক : শিক্ষক, ইমদাদুল উলুম রশিদিয়া মাদরাসা, ফুলবাড়িগেট, খুলনা)