কোটা সংস্কার আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় সরকারের নির্দেশে নিহতদের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পরিবর্তন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, পত্রিকার তথ্যমতে- রাজধানীর ৩১টি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতের সংখ্যা ৬ হাজারের অধিক। যেসব ছাত্রজনতাকে হতাহত করা হয়েছে, তাদের পরিবারকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। অনেক ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ নিহতদের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পরিবর্তন করা হচ্ছে। অনেককে ময়নাতদন্ত ছাড়াই আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করা হয়েছে।
সোমবার বিকালে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এসব কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, চলমান আন্দোলনে নিহতদের নাম ও সংখ্যা নিয়ে সরকার যে তালিকা প্রকাশ করেছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে এর সংখ্যা অনেক বেশি। কিশোর ও আগে নিহতের নাম এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অবিলম্বে সঠিক তালিকা প্রকাশের দানি জানান তিনি।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের মন্ত্রী-নেতারা বারবার বলছেন-প্রকৃত সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করে শান্তি নিশ্চিত করা হবে। বাস্তবতা হলো- সরকার প্রকৃত অপরাধীদের না খুঁজে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমনে উঠেপড়ে লেগেছে। তাদের এ হত্যাযজ্ঞ থেকে বাসা বাড়ির বেলকনি, পড়ার ঘর বা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট সোনামণিরা পর্যন্ত বাদ যায়নি। শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যৌথভাবে যে নির্লজ্জ মিথ্যাচার করছে সেটির সর্বশেষ প্রমাণ হলো- দেশ-বিদেশের সব নাগরিক দেখার পরও রংপুরের আবু সাঈদের মৃত্যুকে গুলিতে নয়, ইটের আঘাতে মৃত্যু হয়েছে বলা হচ্ছে। তবে মিথ্যাচার, অপকৌশল ও নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে প্রকৃত সত্যকে জনগণ থেকে আড়াল করতে পারবে না অবৈধ আওয়ামী সরকার। তাই সব দায় নিয়ে সরকারের উচিত জনদাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পদত্যাগ করা।
তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের ডিবি র্কার্যালয়ে তুলে নিয়ে, চাপ প্রয়োগ করে নির্যাতনের মাধ্যমে কর্মসূচি প্রত্যাহার করা যায়; কিন্তু আবেগ-অনুভূতি এবং সঙ্গীদের রক্তমাখা শার্টের গন্ধ শিক্ষার্থীদের বিবেককে সবসময় তাড়া করবে। সুযোগ পেলেই তারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে সেটির বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে। গণগ্রেফতারের নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং স্থানীয় আওয়ামী সন্ত্রাসীদের দ্বারা নেতাকর্মীদের বাসায় ছিনতাই ও লুটপাটের দৃশ্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন সামাজিকমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
বিবৃতিতে ফখরুল আরও বলেন, এর আগেও এসব অন্যায়-অত্যাচার, আটক, নির্যাতন ও নিপীড়নের প্রতিবাদ করা হয়েছে, কিন্তু কর্তৃত্ববাদী সরকার তা কর্ণপাত করেনি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা সরকারের এসব মানবাধিকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করে তা বন্ধ করার আহ্বান জানালেও সরকার অব্যাহত রেখেছে এবং দিন দিন তা বৃদ্ধি করছে। কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অনির্বাচিত ফ্যাসিস্ট সরকারের ক্ষমতার ভীত নাড়িয়ে দিয়েছে। আন্দোলন দমনের নামে নিষ্ঠুরভাবে রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সন্ত্রাস চালিয়ে শত শত ছাত্র-জনতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। যারা নিহত কিংবা আহত হয়েছেন তাদের অধিকাংশই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারদলীয় সন্ত্রাসী পেটোয়া বাহিনীর ছোড়া গুলিতে।
তিনি আরও বলেন, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরকে নির্যাতনের পর আবার নির্যাতন চালানোর উদ্দেশ্যে ৫ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে; যা গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি রিয়াদ ইকবালকে গোয়েন্দা পুলিশ তুলে নিয়ে যাওয়ার পর এখনো পর্যন্ত তাদের কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। দেশব্যাপী নিরীহ ছাত্র-জনতা এবং বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনসহ অন্যান্য বিরোধী দলের নেতাকর্মী, সাংবাদিক ও পেশাজীবীদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার, গুম করে রাখা হচ্ছে। নির্যাতনের পর পুনরায় নির্যাতনের লক্ষ্যে সিনিয়র নেতাদের বারবার রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে। গ্রেপ্তারকৃতদের ওপর সরকারের অত্যাচার-নির্যাতন চালানোর ঘটনাকে বর্বরোচিত ও কাপুরুষোচিত আখ্যায়িত করে অবিলম্বে এসব দমন-নিপীড়ন বন্ধ করার আহবান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব।
মির্জা ফখরুল বলেন, নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও ভয়-ভীতির কারণে দেশব্যাপী সরকারের নির্মম ও নির্দয় অত্যাচার এবং নিপীড়নের সব তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে জানা সম্ভব হচ্ছে না। তবে বিভিন্নভাবে যেসব তথ্য আসছে সেগুলো রীতিমতো লোমহর্ষক এবং মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কোটা সংস্কারের ছাত্র আন্দোলনের কারণে সাধারণ ছাত্র-জনতাকে এবং একই সঙ্গে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মী ও সাধারণ সমর্থকদেরও বিভিন্ন এলাকায় দিনে-রাতে ও কারফিউ চলাকালে ব্লক রেইড দিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। অনেককে তুলে নিয়ে গেলেও তাদের খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছে না। আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে সোপর্দ করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও গ্রেপ্তারকৃত অনেককে ৪-৫ দিন বা এরও বেশি সময় পর আদালতে নেওয়া হচ্ছে। আটক করার পর আদালতে নেওয়ার আগে এবং রিমান্ডে থাকা অবস্থায়, এমনকি কারাগারে থাকা অবস্থায় আটককৃতদের ওপর অমানুষিক ও অমানবিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। শিক্ষার্থী বা নেতাকর্মীদের আটক করতে বাসা-বাড়িতে অভিযানের নামে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অশালীন আচরণ ও বাসার আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হচ্ছে। নেতাকর্মীদের বাসায় না পেয়ে পরিবারের সদস্যদের আটক করা হচ্ছে। নেতাকর্মীদের কর্মস্থলে পর্যন্ত হানা দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, বারবার মিরান্ডে নেওয়া এবং রিমান্ডে অমানবিক নির্যাতন সংবিধানবিরোধী। সর্বোচ্চ আদালতের এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। নিম্ন আদালতে ঢালাও রিমান্ড দেওয়া সম্পূর্ণ আইনবিরোধী। অবিলম্বে নেতাকর্মীদের রিমান্ডে নেওয়া বন্ধ করার দাবি জানান বিএনপি মহাসচিব। একই সঙ্গে গোয়েন্দা পুলিশের তুলে নেওয়া নেতাকর্মীদের জনসমক্ষে হাজির করার আহবান জানান তিনি।
খুলনা গেজেট/এএজে