খুলনা, বাংলাদেশ | ৩ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১৮ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  বিচার বিভাগকে ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত করার চেষ্টা হচ্ছে : ড. ইউনূস
  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ৮ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১৩৮৯
  পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকেও আমরা ভারত থেকে ফেরত চাইব : প্রধান উপদেষ্টা

সরকার পতনের পর হঠাৎই ভিড় বেড়েছে সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা

বৈষম্য বিরোধী ছাত্রআন্দোলন চলাকালে গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগষ্ট আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর ১১ আগষ্ট থেকে সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট করতে আসা মানুষের ব্যাপক ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। প্রতিদিন গড়ে এক হাজারেরও বেশি মানুষ পাসপোর্ট অফিসে আসছেন নতুন পাসপোর্ট করার জন্য। পাসপোর্ট করতে আসা এসব মানুষের মধ্যে অধিকাংশই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। এর আগে একসাথে এক মানুষের ভিড় এই পাসপোর্ট অফিসে কখনো দেখা যায়নি।

সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস সূত্রে জানা যায়, সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের ৫টা বাই স্টেশনের ধারণ ক্ষমতা প্রতিদিন ৬০ জন করে মোট ৩০০ জনের। আর যদি রাত পর্যন্ত কাজ করা হয় তাহলে ৪০০ থেকে ৫০০ জন মানুষের সেবা প্রদান করা সম্ভব। এরপর মেশিনে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয় (হ্যাং হয়ে যায়)। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বর্তমানে দ্বিগুন-তিনগুন আবেদনকারী পাসপোর্টের জন্য সকাল থেকে অফিসে ভিড় করতে শুরু করেন। গত তিনদিনে (রোববার-মঙ্গলবার) দেড় হাজারের বেশি আবেদন জমা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনদিনে লোকা এসেছে চার হাজারের বেশি।

সূত্র আরো জানায়, নতুন পাসপোর্ট কিংবা নবায়নে নতুন করে ডাটা এন্ট্রি করা হচ্ছে। ই-পাসপোর্টের জন্য চোখের আইরিশসহ ছবি তোলা হচ্ছে নতুন করে। এতে করে নতুন করে ছবি তোলা, আইরিশ নেয়া এবং স্বাক্ষর করার কাজ করতে হচ্ছে অপারেটরদের। প্রতিটি কাজে গড়ে পাঁচ সাত মিনিট সময় লাগছে। এর মধ্যে সার্ভার ডাউনসহ নানা ধরণের প্রযুক্তিগত বিড়ম্বনাও বড় ধরণের সংকট তৈরি করছে। ফলে হঠাৎ করে ধারণ ক্ষমতার বাইরে অধিক সংখ্যক গ্রাহক পাসপোর্ট করতে আসায় তাদের কাঙ্খিত সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।

সরেজমিনে বুধবার (২১ আগষ্ট) সকাল ৬টার দিকে সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ভোরবেলা থেকে পাসপোর্ট অফিসের মেইন ফটকের বাইরে লাইনে দাড়িয়ে আছেন প্রায় পাঁচ শতাধিক পাসপোর্ট করতে আসা গ্রাহক। কাঁক ডাকা ভোর থেকেই এসব গ্রাহকদের লম্বা লাইন শুরু হয়। প্রাচীরের গা ঘেষে রয়েছে মেয়েদের আলাদা লাইন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে লাইনও আরো লম্বা হতে থাকে। প্রচন্ড ভীড়ে একটা সময়ে অফিসের বারান্দা থেকে রাস্তায় লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয় গ্রাহকদের। গ্রাহকদের প্রায় ৯০ শতাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। কেন এতো হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ পাসপোর্ট করতে এসেছেন তা বলতে নারাজ তারা।

পাসপোর্ট করতে আসা গ্রাহক সনদ্বীপ বলেন, সামনে পূজা আর দেশের এই অবস্থায় পরিবার নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট করতে এসেছি। কিন্তু পাসপোর্ট করতে পারবো কিনা বলতে পারছি না। লাইন শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছি।

গ্রাহক অপর্ণা রানী বলেন, চাপা ভয়ে আগে ভাগে পাসপোর্ট করে রাখতেছি যাতে কোন সমস্যা হলে ভারতে যেতে পারি। কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, না আমরা এখনো পর্যন্ত কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়নি। তিনি আরও বলেন, ভোর সাড়ে ৫টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি পাসপোর্ট করার জন্য।

দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন অনুপা রাণী। তিনি বলেন, সোমবার একবার এসে ফিরে গিয়েছি। মঙ্গলবার এসে দেখি দীর্ঘ লাইন। আজ আবার এসেছি লাইন শেষ করে জমা দিতে পারব কিনা জানিনা। বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি কান্নাকাটি করছে তবুও দাঁড়িয়ে আছি কিছু করার নেই। কি কারনে ভারতে যেতে চান জানোট চাইলে বলেন, এমনি আমরা সব সময় ইন্ডিয়াতে যাই। ওখানে আত্মীয়স্বজন আছে। বাসার সবারই পাসপোর্ট আছে শুধু আমারটা নবায়ন করতে হবে। এমনি সবাই মিলে বেড়াতে যাব আর কি। অনেকে এসেছেন কেউ ডাক্তার দেখাতে যাবে, কেউ আবার বেড়াতে যাবে। আমরা প্রায়ই সময় ভারতে যাই বেড়াতে।

সাতক্ষীরা শ্যামনগর থেকে আসা প্রণয় জানান, সকালে এসে লাইন ধরেছেন। তার আগে আরও অনেকেই লাইন ধরেন। ভোর থেকে মানুষ লাইনে দাঁড়ায়। কখন আবেদন জমা দিতে পারবো কে জানে! শুধু প্রণয় নন, এই ধরণের সহস্রাধিক মানুষ প্রতিদিন ভোর থেকে লাইনে ধরে পাসপোর্টের আবেদন জমা দেন।

তবে ভোগান্তি কমাতে দূর-দূরান্ত থেকে পাসপোর্ট করতে আসা গ্রাহকদের সেবা দিতে খোদ উপ পরিচালক মেহেদী হাসান নিজে খোঁজ খবর নেন। এসময় অসুস্থ, বয়স্ক নারী-পুরুষ ও শিশুদের তিনি অগ্রাধিকার দেওয়ার নির্দেশনা দেন দায়িত্বে থাকা সবাইকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আশাশুনি এলাকার একজন গ্রাহক বলেন, গত ৫ আগষ্ট সরকার পরিবর্তনের পর জেলার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। যদিও জেলার কোথাও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা কেউ এখনো তেমন কোন সমস্যার বা ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখিন হয়নি। তারপরও তাদের মধ্যে এক ধরণের ভীতির সঞ্চার হয়েছে। যে কারণে আগের যে কোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা সবচেয়ে বেশি পাসপোর্ট করছে। এখানে প্রতিদিন যে সংখ্যাক মানুষ পাসপোর্ট করতে আসছেন তার প্রায় ৯৮ শতাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের বলে উল্লেখ করেন তিনি।

উপ-পরিচালক মেহেদী হাসান বলেন, সাতক্ষীরা পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিন ৫টা বাই স্টেশনের মাধ্যমে ৩০০জনকে সেবা প্রদান করা যায়। আর যদি রাত পর্যন্ত কাজ করা হয় তাহলে ৪০০ থেকে ৫০০ মানুষের সেবা দেওয়া সম্ভব। গত তিনদিনে আমরা আবেদন জমা নিয়েছি দেড় হাজারের বেশি। কিন্তু বিগত কয়েকদিনে প্রতিদিন পাসপোর্ট করতে আসা গ্রাহকের সংখ্যা এক হাজারের অধিক। তাতে আবার জনবল সঙ্কট থাকায় একজন কর্মকর্তাকে দুই তিনজনের কাজ করতে হয়। তারপরও আমরা সাধ্যমত সেবা দিয়ে যাচ্ছি। যাতে কেউ পাসপোর্ট করতে এসে ভোগান্তির স্বীকার না হয়। উপ-সহকারী পরিচালকসহ ৭জন লোকবল কম নিয়ে আমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে পাসপোর্ট করতে আসা মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, কোন কর্মকর্তা কর্মচারী যাতে অনৈতিক সুবিধা না নিতে পারে তার জন্য পুরো পাসপোর্ট অফিসের সিসি ক্যামেরা সার্বোক্ষণিক সচল রেখেছি। গ্রাহকদের কষ্ট কমাতে বাড়িতে বসে আমার সরকারি হোয়াটস্অ্যাপ নাম্বারের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সেবা দিয়ে থাকি। এছাড়া আবেদনকারীদের ভোগান্তি কমাতে ই-কিউ (ইলেকট্রনিক কিউ) টোকেন সিলিপ দেওয়া হয়ে থাকে। কোন সেবা প্রত্যাশী যাতে হয়রানির স্বীকার না হয় বা দালালের খপ্পরে না পড়ে তার সর্বোচ্চ খেয়াল রাখি।
পাসপোর্ট অফিসকে আমি সর্বোচ্চ সেবার মানদন্ডে নিয়ে যেতে চাই উল্লেখ কওে তিনি আরো বলেন, যে কোন সেবা প্রত্যাশী আমার রুমে এসে সেবা নিতে পারবেন। তিনি দালালদের হুশিয়ারি দিয়ে বলেন, আমি যতদিন থাকবো দলালমুক্ত সাতক্ষীরা পাসপোর্ট অফিস উপহার দিবো। সেজন্য তিনি সকল শ্রেণীপেশার মানুষের সহযোগিতা কামনা করেন।

প্রসঙ্গত, সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে পদ রয়েছে ১৮টি। যার মধ্যে শুন্য রয়েছে ৭টি পদ। মাত্র ১১জন জনবল দিয়ে ৫টি বাই স্টেশনের মাধ্যমে গ্রাহককে সেবা দিচ্ছেন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। জনবলের চরম সঙ্কট নিয়েও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪২ কোটি ৬০ লাখ ৭৬ হাজার রাজস্ব আদায় করেছে সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!