খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনিতে কপোতাক্ষ নদীর উপর সেতু নির্মাণকাজ বন্ধের প্রায় ২০ বছর পর সেখানে ফের সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য সোমবার (২১ আগস্ট) দুপুরে সরকারের এলজিইডি অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যাায়ের একটি টিম সেতুস্থল পরিদর্শন করেছেন।
এলজিইডি অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সেতু ডিজাইন) প্রভাস চন্দ্র বিশ্বাস, প্রকল্প পরিচালক শেখ মো: আবু জাকির সেকেন্দার, নির্বাহী প্রকৌশলী সেতু ডিজাইন) ভাস্কর কান্তি চৌধুরী, সেতু ডিজাইন ইউনিটের নির্বাহী প্রকৌশলী তাপস চৌধুরী, এলজিইডির খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী একেএম আনিছুজ্জামান, উপজেলা প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান খান, সহকারী প্রকৌশরী মো: গোলাম সরোয়ার সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
খুলনা-৬ (পাইকগাছা-কয়রা) সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবুর নেতৃত্বে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, কপিলমুনি ইউপি চেয়ারম্যান কওছার আলী জোয়াদ্দার, হরিঢালী ইউপি চেয়ারম্যান আবু জাফর সিদ্দিকী রাজু, লতা ইউপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পুলকেশ মন্ডলসহ অন্যান্যরা।
এর আগে তারা সকালে পল্লী সড়কে গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ (২য় পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় উপজেলার লতা ইউনিয়নের গুনাখালি ও নড়া নদীর উপর সেতু বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষে প্রস্তাবিত সেতু এলাকা পরিদর্শন করেন।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এমপি আক্তারুজ্জামান বাবু তার প্রতিক্রিযায় বলেন, দ্বীপাঞ্চল লতার সেতু দু’টির নির্মাণ কাজ শেষ হলে দুর্গম জনপদটি মূল যোগাযোগ নেটওয়ার্কের আওতায় চলে আসবে। আর কপিলমুনি সেতু নির্মাণ হলে কৃষি ও বাজার ব্যবস্থাপনায় আমুল পরিবর্তন আসবে বলে এর গুরুত্ব তুলে ধরেন।
সর্বশেষ এলজিইডির ব্রীজ বাস্তবায়নে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে সেতুস্থল পরিদর্শনে ফের সেখানে সেতু নির্মাণে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রসঙ্গত, ব্রিটিশ শাসনামলে আধুনিক কপিলমুনির রুপকার ও বিনোদগঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা রায়সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু জনপদের উন্নয়নে বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ তথা বাজার ব্যবস্থাপনায় তার কর্মযজ্ঞের শুরুতে কপিলমুনিতে গঞ্জ প্রতিষ্ঠা ও তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় কোলকাতার সাথে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থার উত্তোরণে কপোতাক্ষের কপিলমুনিতে একটি সেতু বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন জনপদের সাধারণ মানুষকে। সেই থেকে শুরু সেতুর জন্য স্বপ্ন দেখা।
এরপর ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পাকিস্তানের সাথে দূর্ভাগ্যক্রমে অন্তর্ভূক্তি ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর সরকার ২০০০ সালে গণদাবির প্রেক্ষিতে গুরুত্ব বিবেচনায় কপোতাক্ষের উপর কপিলমুনি সেতুর কার্যক্রম শুরু করেও ২০০৩ সালের ১২ নভেম্বর পর্যন্ত আংশিক কাজ করে আই এফ আই সি ব্যাংক খুলনা শাখা থেকে ১ কোটি ৬৭ লাখ ৭২২ টাকা উত্তোলনের পর এর নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়। এর আগে তৎকালীণ সংসদ সদস্য এড. শেখ মো: নূরুল হক এর মালিকানাধীন এন হক এসোসিয়েট ১ কোটি ৯৩ লাখ ৪২ হাজার ৯শ’ ১৯ টাকা ৫৫ পয়সা ব্যয় বরাদ্দ’র কাজটি শুরু করেন ২০০০ সালের দিকে। পরে কাজের মানোন্নয়নে ব্যয়বরাদ্দ বাড়িয়ে ২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা করা হয়। দরপত্র বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সেতুটির নির্মাণ কাজ পান সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম এ্যাড শেখ মো: নুরুল হকের মালিকানাধীন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এন হক এসোসিয়েট। এরপর নানা প্রতিবন্ধকতায় স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয় এর নির্মাণ কাজ।
তবে এর আগে সেতুর এপ্রোচ সড়ক নির্মাণে দু’পারে জমি অধিগ্রহন ও সংযোগ সড়ক নির্মাণে মাটি ভরাট করে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবে পাউবোর আশংকায় সেতু নির্মাণকাজ বন্ধ হলেও নদের বুকে থেকে যায় সেতুর নির্মাণাধীন ১৮টি পিলার। যা পরবর্তীতে কাল হয়ে দাঁড়ায় নদীর জন্য। অতিসত্ত্বর এর নব্যতা হারিয়ে রীতিমত অস্তিত্ব সংকটে পড়ে খরস্রোতা কপোতাক্ষ। ২০১১ সালে কপোতাক্ষের নব্যতা ফেরাতে সরকার প্রায় ২৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও নদীবক্ষ থেকে অপসারণ করা হয়নি পিলারগুলি।
সর্বশেষ ব্রীজের কাজ স্থাযীভাবে বন্ধ হলেও হাল ছাড়েনি জনপদের মানুষ। চলতি সরকারের শাষনামলে ফের সেতুর দাবিতে সরকারের বিভিন্ন দফতরে আবেদন নিবেদন শুরু করলে নড়েচড়ে বসে এলজিইডি। কপোতাক্ষের কপিলমুনি কেন্দ্রিক সেতুর বাস্তবায়ন হলে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর থেকে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন হবে কপিলমুনির। বর্তমানে দু’টি রোড ক্রস করে ভোমরা থেকে কপিলমুনির দূরত্ব প্রায় ৪০/৪৫ কিলোমিটার। সেতুর বাস্তবায়নে কোন ক্রসরোড ছাড়াই দুরত্ব কমে আসবে অর্ধেকে।
সুন্দরবন উপকূলীয় দক্ষিণের অন্যতম প্রধান বানিজ্যিক কেন্দ্র কপিলমুনি কেন্দ্রিক বিনোদগঞ্জ হয়ে উঠবে বহুমাত্রিক বাণিজ্যিক জোন হিসেবে। হাট ও বাজার ব্যবস্থাপনায় যোগ হবে নতুন নতুন এলাকা। যেখান থেকে এর সুবিধা পৌঁছে যাবে সাতক্ষীরার আশাশুনি, তালা, খুলনার পাইকগাছা, কয়রা, ডুমুরিয়া, দাকোপ, বটিয়াঘাটা তথা সরাসরি খুলনার সাথে।
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত হিমায়িত চিংড়ি, কাঁকড়া, কুঁচের উৎপাদনস্থল সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট হলেও দীর্ঘ দিনেও এর কোন নির্দিষ্ট জোন গড়ে ওঠেনি। সেতুটিকে কেন্দ্র করে বিস্তির্ণ জনপদের পারষ্পরিক স্বার্থ সুরক্ষায় সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় গড়ে উঠতে পারে লবণ পানির চিংড়ি জোন হিসেবে। এছাড়া অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকায় এসব অঞ্চলের উৎপাদিত কৃষি পণ্যের নায্য বাজার দাম থেকে বরাবরই বঞ্চিত হন এখানকার কৃষকরা। সেতুটির বাস্তবায়নে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সাথে সড়ক যোগাযোগে ব্যবস্থা স্থাপন হলে বাজার ব্যবস্থাপনায়ও ঘটবে আমুল পরিবর্তন।
এছাড়া ভারত থেকে ভোমরা হয়ে সরাসরি আমদানি পণ্য যেমন পৌঁছে যাবে কপিলমুনিতে তেমনি রপ্তানি পণ্যও সরাসরি পৌছাবে ভারতে। আর সরাসরি আমদানি রপ্তানির বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বানিজ্যিক সম্প্রসারণে নতুন মাত্রায় যুক্ত হবে নতুন নতুন উদ্যোক্তা।
প্রসঙ্গত, দু’পারের জনপ্রতিনিধিদের ঐক্যবদ্ধ প্রক্রিয়া ও স্থানীয় সৃষ্টিশীল গুটি কতক মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সেতুর বাস্তবায়নের বিষয়টি ফের আলোচনায় আসে। যার ধারাবাহিকতায় আজ সোমবার এলজিইডির উচ্চ পর্যায়ের একটি টিম সেতু এলাকায় পরিদর্শনে নতুন করে সেতুর ভাবনা জনপদের সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করেছে।
খুলনা গেজেট/কেডি