অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান । বহুপ্রত্যাশিত স্বপ্নের পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যদিয়ে নতুন এক ইতিহাস রচিত হল। তৈরি হল রাজধানীর সাথে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মেলবন্ধন। খুলে গেল দখিনের দুয়ার।
অনুভূতি, গর্ব আর অহংকারের সেতু পদ্মা। এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রতীক। শত বাধা পেরিয়ে অসম্ভবকে জয় করে প্রমত্ত পদ্মার ওপর নির্মিত হয়েছে অপার সম্ভাবনার সেতু। স্বপ্ন-সাধ-আর বিশ্বাসের গাঁথুনিতে অসাধ্যকে সাধন করার এক দুর্বার সফলতা পদ্মা সেতু। ফলে সম্ভাবনার নতুন অধ্যয়ে বাংলাদেশ।
দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ও বহু কাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু আজ আর স্বপ্ন নয়, সত্যি। বাঙালির দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পদ্মার ওপর নির্মিত হয়েছে সেতু। নিজ অর্থে বিশাল এ সেতু বানিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ।
উদ্বোধনের আগে স্মারক ডাকটিকিট, স্যুভেনির শিট, উদ্বোধনী খাম ও বিশেষ সিলমোহর উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। পরে তিনি মাওয়ায় স্থাপিত টোল প্লাজায় টোল পরিশোধের পর উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-১ উন্মোচনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন।
উদ্বোধন শেষে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তের উদ্দেশে যাত্রা করেন শেখ হাসিনা। এসময় মাঝ সেতুতে দাঁড়িয়ে বিমান বাহিনীর ৩১টি বিমান ও হেলিকপ্টারের সমন্বয়ে এক মনোজ্ঞ ‘ফ্লাইং ডিসপ্লে’র উপভোগ করেন তিনি। সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলসহ অন্যরা।
এসময় দুটি মিগ-২৯, দুটি এফটি-৭বিজি/এফ-৭ এমবি ও দুটি এফ-৭ বিজিআইর সমন্বয়ে স্মোক পাস, তিনটি এফ-৭ বিজিআই/বিজির ফ্লাই পাস্ট প্রদর্শন, একটি সি-১৩০জে ও পাঁচটি কে-৮ ডব্লিউর সমন্বয়ে স্মোক পাস প্রদর্শন, তিনটি এল-৪১০ ও পাঁচটি গ্রোব-১২০টিপির সমন্বয়ে ফ্লাই পাস্ট প্রদর্শন, পাঁচটি এমআই-১৭/১৭১ এর মাধ্যমে পতাকা প্রদর্শন ও একটি বেল-২১২ এর মাধ্যমে লিফলেট বিতরণ, দুটি কে-৮ডব্লিউর মাধ্যমে শেকুল মেন্যুভার প্রদর্শন, পাঁচটি কে-৮ডব্লিউ এর মাধ্যমে ভিক্সেন ব্রেক প্রদর্শন এবং একটি মিগ-২৯ এর মাধ্যমে লো লেভেল অ্যারোবেটিক্স প্রদর্শন করা হয়।
পাঁচ হেলিকপ্টারের একটি বহরের শুরুতেই ছিল লাল সবুজের পতাকা। যা জানান দেয় বাঙালির আত্মমর্যাদা, সক্ষমতার।
দ্বিতীয়টিতে ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সম্বলিত পতাকা। অসীম আকাশে পাখা মেলে জানান দিয়ে গেল দাবিয়ে রাখা অসম্ভব অদম্য বাঙালিকে।
দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে যার দৃঢ়তায় স্বপ্নের এই পদ্মা সেতু, বিমানবাহিনীর এই মনোমুগ্ধকর প্রদর্শনীর তৃতীয় হেলিকপ্টারে ছিল বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি সম্বলিত পতাকা।
চতুর্থ ও পঞ্চম হেলিকপ্টার বহন করে স্বপ্নজয় ও জাতীয় স্লোগান জয়বাংলা সম্বলিত পতাকা। যেন কোটি বাঙালিকে আরেকটিবার ডাক দিয়ে গেল সম্মিলিত বিজয় উল্লাসে সামিল হওয়ার।
নীল আকাশে লাল সবুজের আবিরে ফুটিয়ে তোলা হয় বাংলাদেশের পতাকার অবয়ব। এক পর্যায়ে হাজির হয় যুদ্ধ বিমান। গর্জন তুলে জানান দেয় ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে এগিয়ে যাওয়ার। পদ্মার আকাশে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অ্যারোবেটি ডিসপ্লেটি ও ফ্লাই পাস মন্ত্রমুগ্ধ করে অপেক্ষমাণ পদ্মা পাড়ের মানুষকে।
পরে জাজিরা পয়েন্টে পৌঁছে সেতু ও ম্যুরাল-২ এর উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করেন।
এই সেতুকে ঘিরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গড়ে উঠবে বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক জোন। তৈরি হবে নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান, বাড়বে কর্মসংস্থান। গতি বাড়বে বেনাপোল, মোংলা, ভোমরা ও পায়রা বন্দরের। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটবে এবং সহজতর হবে। কৃষি, মৎস্যসহ বিভিন্ন পণ্য পরিবহণে ব্যয় ও সময় বাঁচবে এবং যাতায়াতে সহজ হবে। এই সেতুর কল্যাণে আমূল বদলে যাবে দক্ষিণাঞ্চলের ক্রীড়াঙ্গনও। সুন্দরবন এবং কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতসহ নানা প্রত্নতাত্ত্বিক ও দর্শনীয় স্থানগুলোতে পর্যটক বাড়বে।
শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলই নয়, পদ্মা সেতুর সুফল মিলবে গোটা দেশের মানুষের। উন্মোচন হবে নতুন সম্ভাবনার দ্বার। ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও শিল্পায়নের মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এ সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নদীশাসনের ফলে যেমন ভাঙন আতঙ্কও দূর হয়েছে পদ্মার, তেমনি দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যাতায়াতের দীর্ঘ সংকটও কাটছে। কেটেছে ঝড়-ঝঞ্ঝা মাথায় নিয়ে খরস্রোতা পদ্মা পাড়ি দেওয়ার ভোগান্তি। থাকছে না ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার প্রহরও। পদ্মা পার হওয়া যাবে এখন ৫-৬ মিনিটে। পাশাপাশি তৈরি হয়েছে পর্যটনসহ নানা খাতে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ। যেটি দেশের প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখবে।
সমীক্ষা অনুযায়ী, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়াবে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। তবে দক্ষিণাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে ২১ জেলার মানুষের যে স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে, তার মূল্য অর্থনৈতিক হিসাবের চেয়ে ঢের বেশি।
দুই স্তর বিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিটে নির্মিত এই সেতুর উপরের স্তরে চার লেনের সড়কপথ এবং নিচের স্তরে একক রেলপথ। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য সেতুটি নির্মাণে ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ধরা হলেও খরচ হয়েছে ২৭ হাজার ৭৩২ কোটি ৮ লাখ টাকা।
খুলনা গেজেট/ টি আই