‘স্কুল খুলবে, সবার সঙ্গে দেখা হবে; সেই আনন্দে রাতে ঠিক করে ঘুম হয়নি। খুব সকালে উঠে দ্রুত স্কুলে আসার প্রস্তুতি নিয়েছি সবার সঙ্গে দেখা হবে, ক্লাস করব। স্কুলে এসে খুবই ভালো লাগছে, এখন সবার সঙ্গে কথা বলতে পারব।’ দীর্ঘ দেড় বছর পর স্কুলে আসার অনুভূতির কথা এমনভাবেই প্রকাশ করল খুলনা মেট্রো পুলিশ লাইনস হাইস্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সেতু রায়।
এই শিক্ষার্থী বলে, এতদিন বাড়িতে একা একা পড়েছি। তেমন ভালো লাগত না। দীর্ঘদিন সহপাঠীরা মিলে স্কুলের আঙিনায় যেতে পারিনি। স্কুল খুলেছে। এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিয়মিত স্কুলে আসতে চাই।
একই ক্লাসের ছাত্রী প্রিয়াংকা মন্ডল বলে, স্কুল খোলার আগের দিনগুলো খুব বিরক্তিকর ছিল। আর বাসায় বসে থেকে কিছুটা আলসে ভাব ধরে যায়। কিন্তু আজ স্কুল খোলার পর থেকে সকালের অনুভূতিটা একটু অন্য রকম। স্কুলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবার সঙ্গে এক দেখা হলো। আমরা চেষ্টা করব এই পরিবেশটা ধরে রাখতে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে লেখাপড়া এগিয়ে নেওয়ার জন্য।
শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, আনন্দের বন্যা দেখা গেছে বিদ্যালয়ের আয়া রওশন আরা বেগমের মনেও। তিনি বলেন, ১৭ মাস পর্যন্ত স্কুল বন্ধ ছিল, খুব খারাপ লাগত। স্কুলের বাচ্চাগুলো আন্টি, খালামণি বলে জড়িয়ে ধরত। তাদের খুব মিস করেছি। কষ্ট পাইতাম, তারা আসে না। এখন তারা এসেছে। আমার কাছে খুবই ভালো লাগছে।
রোববার (১২ সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ঘুরে দেখা যায়, সকাল থেকেই স্কুল-কলেজের প্রধান ফটকের সামনে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা উপস্থিত হতে শুরু করেন। নির্দিষ্ট সময়ে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে প্রবেশ করানো হয়। স্কুলের প্রধান ফটকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিরাপত্তা প্রহরীরা সারিবদ্ধভাবে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে প্রবেশ করান। সামনেই শিক্ষার্থীদের অভ্যর্থনা জানাতে শিক্ষকরা দাঁড়িয়ে ছিলেন। একজন শিক্ষক তাপমাত্রা মাপছেন, অন্য শিক্ষক হ্যান্ডস্যানিটাইজার দিচ্ছেন। কারও মাস্ক না থাকলে তাকে মাস্ক দেওয়া হচ্ছে।
এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা পাশেই নির্ধারিত স্থানে রাখা সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ক্লাসে প্রবেশ করে। আয়া ও দপ্তরি ঘণ্টা বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে চিরচেনা রূপ নেয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। প্রাণ ফিরে পায় খুলনার স্কুল-কলেজগুলো। দীর্ঘ দেড় বছরের শূন্যতা পূরণ হয় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে।
খুলনা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে জেলার সব সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা খুলে দেওয়া হয়েছে। খুলনা জেলায় ১ হাজার ১৫৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৪২০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে মহানগরে ১৫৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১০০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বাকিগুলো জেলার নয়টি উপজেলায় অবস্থিত। এ ছাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৪২০টি স্কুল, ১২৫টি মাদ্রাসা ও ৭৩টি কলেজ রয়েছে।
খুলনা মেট্রো পুলিশ লাইনস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল খোলা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা স্কুলে এসেছে। এখন খুবই ভালো লাগছে। করোনার কারণে দীর্ঘ দেড় বছর স্কুল বন্ধ ছিল। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল খুলে দেওয়ার জন্য। শিক্ষার্থীদের আগমনে স্কুল আজ প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
তিনি বলেন, সকালবেলা শিক্ষার্থীদের মুখ দেখে মনে হলো আমার সন্তানদের ফিরে পেয়েছি। আমার নিজের সন্তানরা এতদিন দূরে ছিল, আমি আজ তাদের কাছে পেয়েছি। আমি খুবই আনন্দিত। আজ ক্লাস শুরু হয়েছে। স্কুলে প্রথম থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী পর্যন্ত রয়েছে। রুটিন অনুযায়ী সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত ক্লাস চলবে।
প্রথমে নবম এবং এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্লাস চলছে। পরবর্তী সময়ে পঞ্চম ও দশম শ্রেণির ক্লাস চলবে। প্রতিটি ক্লাসে তিন ফুট সামাজিক দূরত্ব মানা হয়েছে। স্কুলে প্রবেশের সময় হাত ধোয়া, মাস্ক পরিধান ও তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থা রেখেছি। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে অনুসরণ করেছে।
বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সামসুন্নাহার মুনা বলে, অনেক দিন পর স্কুলে এসে সহপাঠীদের সঙ্গে দেখা করে খুব ভালো লাগছে। অনলাইনে ক্লাস হতো কিন্তু ভালো লাগত না। এখন সরাসির ম্যাডামদের সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগছে। স্কুল থেকে মাস্ক ও স্যানাটাইজারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলব।
একই শ্রেণির শিক্ষার্থী সোনাহারী জান্নাত মাহি বলে, আজ বিদ্যালয়ে এসে ভালো লাগছে। সহপাঠী ও শিক্ষকদের সঙ্গে মিশতে পারছি। শিক্ষকরা আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন। অনেক দিনের শূন্যতা ছিল, যা আজ স্কুলে এসে পূরণ হয়েছে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, শিক্ষার্থীরা যাতে নিরাপদে ক্লাস করতে পারে, তার সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছি। দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর স্কুল বন্ধ থাকলেও আমরা অনলাইনে ক্লাস নিয়েছি, বাড়ির কাজ দিয়েছি। পড়াশোনা চালু ছিল। কিন্তু বিদ্যালয়ের আঙিনা শূন্য ছিল।
তিনি বলেন, বিদ্যালয়ে আমরা এসেছি, প্রশাসনিক কাজ করেছি। কিন্তু আমরা ৩৫০ জন শিক্ষার্থীর কেউ ছিল না। ভেতরটায় খুব কষ্ট ছিল। খারাপ লাগত। মনে হতো, তাদের ডেকে একটু আদর করি, শাসন করি, পড়ায় উপদেশ দিই। এটা কবে করতে পারব? আজ সবকিছুর অবসান ঘটল। নিরাপদ পরিবেশে পড়াশোনা করাতে পারব। যে শিক্ষণ ঘাটতি হয়েছে, সেটা আমরা পুরোপুরি পূরণ না করতে পারলেও কিছুটা যাতে আমরা অর্জন করতে পারি।
শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা অর্জনের জন্য কী পদক্ষেপ নিতে হবে, এ বিষয়ে সব শিক্ষক, এসএমসিসহ সবাই বসে আলোচনা করেছি। সেই মোতাবেক কাজ করব, বলেন তিনি।
খালিশপুর আলফালাহ একাডেমীর ম্যানেজিং কমিটির সদস্য নূর হাসান জনি বলেন, দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শূন্যতা ছিল। আজ স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল খুলেছে। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ মুখর হয়েছে। অনেক দিন পরে তারা ক্লাস করতে পেরে উল্লসিত এবং তাদের নিরাপদ ব্যবস্থা করতে পেরে আমরাও উচ্ছ্বসিত। বিদ্যালয়ে যে শূন্যতা ছিল, তাদের উপস্থিতিতে তা আজ পূর্ণ হয়েছে।
খুলনার শহীদ তিতুমীর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ইউনুছ আলী বলেন, শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুলে এসেছে। তাদের মাঝে প্রচুর উৎফুল্লতা দেখেছি। অভিভাবকরাও খুশি। সেই সঙ্গে শিক্ষকদের ভেতরে প্রাণচঞ্চলতা ফিরে এসেছে।
বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ইমরান হোসেন বলে, বাসায় বসে সময় কাটিয়েছি অনেক দিন। এখন স্কুলে এসে স্যারদের সঙ্গে এবং বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। খুব ভালো লাগছে। আমি এভাবে স্কুলে করতে চাই আনন্দের সঙ্গে।
এদিকে স্কুলগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানলেও সামাজিক দূরত্বের বালাই দেখা যায়নি খুলনার সরকারি হাজী মুহম্মদ মুহসিন কলেজে। সরেজমিনে বেলা সোয়া ১১টার দিকে কলেজে প্রবেশ করতেই দেখা যায় এক ভিন্ন চিত্র। ছিল না সামাজিক দূরত্ব, অনেকেই মাস্ক ছাড়াই প্রবেশ করেছে। শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতিতে ক্লাসের সামনে জটলা বেঁধে যায়। কলেজের ১০১ নম্বর কক্ষে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্লাসের প্রতিটি বেঞ্চে তিন থেকে চারজন করে বসতে দেখা যায়। পেছনের সারিতে বসতে না পেরে অনেকেই বেঞ্চের পাশে ও পেছনে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
শুধু ক্লাসের অবস্থায় এমনটা নয়, জটলার কারণে ক্লাসে প্রবেশ করতে না পারায় অনেক শিক্ষার্থী ক্লাসের সামনে দরজায় এবং বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। এক ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বসাতে না পেরে কলেজের অধ্যক্ষ দ্বিতীয় তলায় শিক্ষার্থীদের আরও দুটি ক্লাসে ভাগ করে দেন। তবে সেখানেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য ছিল।
শিক্ষার্থী অনেক বেশি জেনেও কেন পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন কক্ষে ক্লাস নেওয়া হয়নি সেখানে, এমন প্রশ্নে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরই শেষমেষ তিনটি ক্লাসে ভাগ করে ক্লাস নিতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. গোলাম মোস্তফা।