বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য অর্থবহ সংলাপসহ যে পাঁচ দফা সুপারিশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা,সেগুলোর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারেরও সমর্থন রয়েছে। পর্যবেক্ষকরা ওই পাঁচ সুপারিশ করার পরদিন গতকাল সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আফরিন আখতার এ তথ্য জানিয়ে বলেন, প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সুপারিশগুলো যুক্তরাষ্ট্র আমলে নিয়েছে।
আফরিন আখতার তিন দিনের সফরে গতকালই ঢাকায় এসেছেন। প্রথম দিনই তিনি বৈঠক করেছেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মাসুদ আলমের সঙ্গে।
বৈঠকগুলোর পর গতকাল বিকেলে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছে, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। বৈঠকগুলোতে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের জোরালো ও বহুমুখী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ যাতে ভোট দিতে পারে তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রচেষ্টা, রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা, স্বাধীন ও নির্দলীয় নির্বাচন জরিপ দলের সাম্প্রতিক সফর, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের বহুদিনের উন্নয়ন অংশীদারি, বাণিজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য।
পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) সুপারিশগুলোর বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ওই সুপারিশগুলোর বিষয়ে প্রায় একমত।
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। বাংলাদেশও এ ব্যাপারে অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। এনডিআই ও আইআরআই নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠালে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যতটা সম্ভব সহযোগিতা দেবে।
পররাষ্ট্রসচিব জানান, তিনি র্যাবের ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনুরোধ তুলে ধরেছেন। এ বিষয়ে সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আইনি সেবা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বৈদেশিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ দপ্তরে (ওফাক)’ বাংলাদেশ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব অন্তত ব্যক্তিবিশেষের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হবে বলে বাংলাদেশ আশাবাদী।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বাহিনী হিসেবে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সঙ্গে সংস্কারের শর্ত জড়িত।
সেটি প্রত্যাহারে কিছুটা সময় লাগতে পারে। ব্যক্তিবিশেষের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞাগুলো তুলে নেওয়া হলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
বৈঠকে ফিলিস্তিন, বিশেষ করে গাজা পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্রসচিব। তিনি বলেন, গাজায় বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) ফিলিস্তিনবিষয়ক বিশেষ সভায় যোগ দেবেন। সেখানে তিনি ফিলিস্তিন নিয়ে বঙ্গবন্ধু অনুসৃত নীতি অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরবেন।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বাংলাদেশ অনতিবিলম্বে সংঘাতের অবসান চায়। মানবিক সহায়তার সুযোগ চায় বাংলাদেশ। এ বিষয়ে সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ মার্কিন প্রশাসনকে অনুরোধ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রও এখন বলছে, ইসরায়েলের গাজা দখল করাটা ভালো কাজ হবে না। যুক্তরাষ্ট্র গাজা দখল করা থেকে ইসরায়েলকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্রসচিব। প্রত্যাবাসন বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ও সর্বশেষ তথ্য তিনি মার্কিন ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারিকে বলেছেন। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু উদ্বেগ থাকার কথা উল্লেখ করে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, নিরাপত্তা ও রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতিও বাংলাদেশ আমলে নিচ্ছে। বাংলাদেশ জোর করে বা কোনো রোহিঙ্গার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিয়ানমারে পাঠাবে না। এ বিষয়ে মিয়ানমার ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ যোগাযোগ রাখবে।
পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে বৈঠকের আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালকের সঙ্গে বৈঠকে আফরিন আখতার সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পৃক্ততা, বাণিজ্য, বিনিয়োগের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বলেন, নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন করে কোনো চুক্তির সম্ভাবনা নেই।
বাংলাদেশের কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে—বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে এমন খবর এসেছে। এ বিষয়ে আফরিন আখতারের সঙ্গে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে কি না পররাষ্ট্রসচিবের কাছে জানতে চান সাংবাদিকরা। জবাবে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, এ বিষয়টি আফরিন আখতার বা তিনি—কেউই তোলেননি।
সংলাপের বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘সংলাপ হবে কি হবে না সেটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। এ নিয়ে তিনি (আফরিন আখতার) আমাকে কোনো প্রশ্ন করেননি।’
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, আফরিন আখতার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। সর্বশেষ গত মে মাসে ঢাকা সফরে এসেছিলেন। তিনি বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দেখভাল করেন। এ ছাড়া তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিরাপত্তা ও আন্তর্দেশীয়বিষয়ক কার্যালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন।