বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কা হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছে বিশ্ব আর্থিক খাতের মোড়ল সংস্থা বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ হান্স টিমার বলেছেন, ‘বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থানে নেই। কারণ দেশটির বিদেশি ঋণের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম এবং তা মাত্র জিডিপির ১৭ শতাংশের মতো। আর এই ঋণের বড় অঙ্ক বিশ্ব ব্যাংকের মতো বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে স্বল্প সুদ আর সহজ শর্তের ঋণ।’
বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বব্যাংক সদর দপ্তরে সংস্থাটির ‘সাউথ এশিয়া ইকোনমিক আপডেট’ প্রকাশ উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে টিমার শ্রীলঙ্কার চেয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক বেশি শক্তিশালী অবস্থানে আছে উল্লেখ করে এ কথা বলেন। ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে এই সংবাদ সম্মেলন হয়।
তিনি বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে বাংলাদেশ শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির পথে হাঁটছে। করোনার মধ্যেও বাংলাদেশ ভালো করেছে। চলতি অর্থবছরে ভারত ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বেশি হবে।’
তবে কিছু ঝুঁকির কথাও বলেছেন তিনি। টিমার বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে। এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।’
ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। দুই কোটি জনসংখ্যার দেশটির অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ার পর তাদের বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধই শুধু অনিশ্চয়তায় পড়েনি, নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক সংকট।
এ অবস্থায় মঙ্গলবার দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে বিদেশি ঋণ পরিশোধে নিজেদের অপারগতা প্রকাশের কথা জানিয়েছে।
মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে থাকা শ্রীলঙ্কার হাল দেখে বাংলাদেশে কেউ কেউ শঙ্কা প্রকাশ করলেও সরকার আশ্বস্ত করছে, তেমন আশঙ্কার কিছু নেই।
তবে শ্রীলঙ্কা থেকে শিক্ষা নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ টিমার।
তিনি বলেন, ‘এখনও বাংলাদেশে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে। এটা ছয় মাসের বেশি সময় আমদানি চালিয়ে যেতে সক্ষম। এটা একটা সন্তোষজনক পরিস্থিতি।’
‘কিন্তু এটা এখন দেশীয় মুদ্রার অস্থিরতা সামাল দিতে ব্যবহার করা হচ্ছে, আবার উন্নয়ন বিনিয়োগের জন্যও ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে; বৈদেশিক মুদ্রার এমন ব্যবহারের ক্ষেত্রে শক্ত নিয়ন্ত্রণ রাখা উচিৎ।’
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ভালো অবস্থায় আছে উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংকের এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘ঋণ নিয়ন্ত্রিত অবস্থায়, বিশেষ করে বৈদেশিক ঋণ কমই আছে।’
বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় ঋণ বাড়ার ইতিবাচক দিক তুলে ধরে বিশ্বব্যাংকের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘মধ্যম আয়ের যে কোনো দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় ঋণ খুব উপযোগী হতে পারে। কেননা, বিদেশিরা অর্থনীতিতে যুক্ত হলে বেশি সুফল পাওয়া যায় এবং এটা বেশ কার্যকর।’
‘কিন্তু আপনাকে সতর্কভাবে দেখতে হবে, দ্বিপক্ষীয় ঋণের অর্থায়ন কতটা উৎপাদক্ষম হচ্ছে।’
বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই কম হওয়ায় তা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে সরকারকে পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশ কেনো শ্রীলঙ্কা হবে না-তার পক্ষে যুক্তি ও তথ্য উপাত্ত তুলে ধরে মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে অর্থসচিব আ্ব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, “গত ১৩ বছরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় আছে। তার সুফল অর্থনীতি পাচ্ছে। আমাদের অর্থনীতির ‘থ্রি আর’আরএমজি, (তৈরি পোশাক), রেমিট্যান্স এবং রাইস (চাল বা ধান) চমক দেখিয়ে চলেছে। বছরের পর বছর ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তৈরি পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে ৪০ শতাংশ। রেমিট্যান্সও ইতিবাচক ধারায় আছে। এই তিন খাতেই শ্রীলঙ্কা নাজুক অবস্থায় আছে, সংকটে আছে। সে কারণেই তাদের এই বিপদ এসেছে।”
তিনি বলেন, ‘মহামারি করোনার ধাক্কা দ্রুত কাটিয়ে উঠেছি আমরা। পৃথিবীর অনেক দেশই তা বাড়েনি। গত অর্থবছরে আমরা ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। চলতি অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশের বেশি অর্জিত হবে। রাজস্ব আদায়ে ১৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়ে ১১ শতাংশে উঠেছে।
‘সবমিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্ত মজবুত ভিক্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি।’
সংবাদ সম্মেলনে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি ) সচিব সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলেন, ‘আমাদের বিদেশি ঋণ জিডিপির ১২ শতাংশ; আর শ্রীলঙ্কার ৪৮ শতাংশ। আমাদের ঋণের সুদের হার মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার ১২ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৩৫ বিলিয়ন ডলার। আমাদের ৫০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের ঋণ ঝুঁকিমুক্ত। শ্রীলঙ্কাকে প্রতি বছর সুদ-আসল বাবদ সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হয়। আমাদের করতে হয় আড়াই বিলিয়ন ডলার।
‘আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমাদের কোনো সভরেন বন্ড ঋণ নেই, বাণিজ্যিক ঋণ নেই। আমাদের ঋণ পরিশোধ নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেই। আগামী ১০ বছর ঋণ পরিশোধে কোনো সমস্যা নেই বাংলাদেশের। অথচ শ্রীলঙ্কার এক কিস্তি শোধ করারও ক্ষমতা নেই।’
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বুধবার দিন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ছিল ৪৪ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার। এই রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন
বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংস্থাটি বলেছে, দুই বছরের করোনাভাইরাস মহামারি সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করে অর্থনীতিকে শক্তিশালী ভিত্তির উপর রেখেছে বাংলাদেশ। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তার মধ্যে বিশ্বব্যাপী পণ্যমূল্যের আগুনে নতুন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রশংসা করে করোনা মহামারির এই সংকটের সময়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের আশার কথাও শুনিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
সংস্থাটি বলেছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। আর আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে হতে পারে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ।
অতি দারিদ্রের হার কমে ১১.৯ শতাংশ
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্ব্যাংক বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশে অতি দারিদ্র্য হার ছিল ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। গত ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে তা ১১ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে।
অতি দারিদ্র্যের হারকেই আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমা হিসেবে ধরা হয়। কোনো দেশে এ হার ৩ শতাংশের নিচে নেমে এলে ওই দেশকে ‘দারিদ্র্যমুক্ত দেশ’হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) মূল উদ্দেশ্য অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হওয়ার লক্ষ্য আছে।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, দৈনিক ১ ডলার ৯০ সেন্ট আয় করতে পারলে ওই ব্যক্তিকে দরিদ্র হিসাবে ধরা হয় না।
খুলনা গেজেট/ এস আই