ওরা তিন ভাই এইদিনে একসাথে এসেছিল ওদের মায়ের কোল জুড়ে। খুলনার মহেশ্বরপাশা বস্তিতে সেদিন বৃষ্টি এলো, রোদ এলো। বস্তিজুড়ে মানুষ ভিড় জমালো চন্দ্র, সূর্য, তারার মায়ের ভাঙা ঘরে। সবার মুখে মিষ্টি হাসি দেখা গেল। সবাই বললো, ‘এই বেটীর কপাল কত বড়। একসাথে তিন পোলা’।
কিন্তু এই মা চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে লাগলো। ঘরের ফুটো চাল দিয়ে ঝরঝর করে আষাঢ়ের বৃষ্টির পানি পড়ে আঁতুড় ঘর ভিজে গেল। তিন ছেলের জন্য এতো বুকের দুধ তাকে আলাদা করে বিধাতা দেয়নি। ওদের বাবা শ্রমিকের কাজ করে চট্টগ্রামে। সেও আজ কাছে নেই। তাই এই মা ঘন ঘন আল্লাহর কাছে বেশি বেশি বুকের দুধের জন্য আবদার করে। তবুও বুকের দুধ একটুও বাড়ে না। শুধু আষাঢ়ে বৃষ্টিতে ঘরের ফুটো চালের ফাঁক দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ে ঘর ভরতে থাকে।
বস্তির পাশেই থাকতো সোনামুখ পরিবারের সভাপতি মানসুরা ইসলাম। সে তখন সরকারি বিএল কলেজে বাংলায় অনার্স পড়তো। তারও আর্থিক অবস্থা বেজায় দুর্বল। টিউশনি করে কোনমতে লেখাপড়ার খরচ সংকুলান করতো। থাকতো বড় বোনের আশ্রয়ে।
বস্তিতে এক মহিলার কোলে তিনটি ছেলে একসাথে জন্ম নেওয়ার সংবাদ শুনে সকলের মতো মানসুরাও তাদের দেখতে গেল। অনেক মানুষের ভিড়ে ঐ তিনটি ছেলের মুখ দেখে মানসুরার মনে মাতৃত্বের ভাব ফুটে উঠলো। সে তিনটি ছেলেকে বার বার কোলে নিয়ে আদর করলো। ওদের মায়ের অসহাত্ব অনুধাবন করতে মানসুরার তেমন সময় লাগলো না। সোনামুখ পরিবারের সাথে কাজ করতে করতে ইদানীং মানসুরা অসহায় মানুষের মনের কথা সহজেই বুঝতে পারে। তার নিজের জন্মদিনও সমাগত।
ঐদিন সোনামুখ পরিবারের অফিসে মানসুরার জন্মদিনের আয়োজন নিয়ে আলোচনা চলছিল। মানসুরা এসব জানতো। তাই সে বস্তি থেকে সোজা সোনামুখ পরিবার অফিসে এলো। আমি তখন সেখানেই ছিলাম। সোনামুখ পরিবারের আরো অনেক সদস্য সেখানে হাজির ছিল। হঠাৎ মানসুরা হন্তদন্ত হয়ে অফিসে ঢুকে তার জন্মদিন আয়োজনের আলোচনা বন্ধ করতে অনুরোধ করলো। উপস্থিত সকলে হতবাক হয়ে তার অভিপ্রায় জানতে চাইলো।
মানসুরার স্বভাব একটু ভিন্ন। সে কথা বলার সময় দাড়ি কমা দেয় না। কথার মাঝে আবেগ এলে চোখ দিয়ে পানি পড়ে। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হলো না। সে তার বাসার পাশে বস্তিতে জন্ম নেওয়া ঐ তিনটি ছেলের কথা বলতে গিয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কেঁদে ফেললো। সোনামুখ পরিবারের সকল সদস্য মানসুরার আবেগে আপ্লুত হলো। আমিও তাদের আবেগে আপ্লুত হয়ে তৎক্ষনাৎ সকলকে নিয়ে সেই বস্তিতে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। সবার সাথে আলোচনা করে যাবার আগে পর্যাপ্ত পরিমাণে শিশুখাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সকল জিনিসপত্র কেনা হলো।
সোনামুখ পরিবারের উপস্থিত সকল সদস্য নিয়ে আমি সেই বস্তিতে গিয়ে ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লাম। ওখানে দাঁড়িয়েই এই তিনটি শিশুর নাম দিলাম চন্দ্র, সূর্য, তারা। সৃষ্টিকর্তার অপার রহস্য দেখতে পেলাম ওদের চোখেমুখে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম- এই তিনটি শিশুকে কোন প্রকারে খাবার অভাবে মরতে দিবো না। আল্লাহ যেন আমাদের সহায় হন।
সেই থেকে আজ দুই বছর ওদের খাওয়া পরার দায়িত্ব নিতে পেরে সোনামুখ পরিবার ভীষণ আত্মতৃপ্তি উপলব্ধি করছে। সোনামুখ পরিবারের এই মহতি উদ্যোগে ইতিমধ্যে আরো কিছু মহাপ্রাণ মানুষ শরীক হয়ে সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। চন্দ্র, সূর্য, তারা দিনে দিন বেড়ে উঠছে। আজ তাদের দুই বছর পূর্ণ হলো। আমার বিশ্বাস তারা একদিন পৃথিবীতে ভিন্ন আলো ছড়াবে। ওরাই হবে আমার ভবিষ্যতের সোনামুখ।
(লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা)
খুলনা গেজেট/এনএম