জন্মের ১৫ মাসেও শিশুকন্যা হৃদী মন্ডল স্বাভাবিক চলাফেরা ও কথা না বলায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন সরস্বতী মন্ডল ও অমিয় মন্ডল দম্পত্তি। খিঁচুনিতে প্রায়ই মেয়ের জীবন যায়-যায় অবস্থা। একমাত্র সন্তানের এমন অবস্থায় ভেঙে পড়েন মা-বাবা। নানা কথায় মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। ডাক্তারের পরামর্শেও সুফল মেলেনি। তবে মাত্র ১১ মাসের ব্যবধানে অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে হৃদী। বাড়ির উঠানে দৌঁড়ঝাপ ও খেলা করেই সময় কাটে। নিয়মিত ওজন পরিমাপ, চাল-ডাল, সয়াবিন তেলসহ বিভিন্ন উপকরণে হাতে তৈরী পুষ্টি খাবার পাল্টে দিয়েছে সরস্বতী-অমিয় দম্পতির পরিবারের চিত্র। এ দম্পত্তি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা হিসেবে পরিচিত মনোহরপুর গ্রামের বাসিন্দা।
শিশু পুষ্টি নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় জনগোষ্ঠী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সচেতনতামূলক কার্যক্রমে অনেকটাই ব্যতিক্রম খুলনা শহরতলীর সবচেয়ে বড় উপজেলা ‘ডুমুরিয়া’। উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে এ সচেতনা সৃষ্টি হওয়ায় যেমন দিন দিন বাজেট বাড়ছে, তেমনি হাজারো পরিবারে শিশুদের নিয়ে হাসি ফুটেছে। ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে স্বাস্থ্য-পুষ্টি, স্যানিটেশন খাতে বাজেট বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বেসরকারি সংস্থাসমুহের সচেতনামূলক কার্যক্রম, ইউনিয়ন পরিষদের স্থায়ী কমিটি কার্যকর হওয়া, প্রতিটি ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা স্তরে নাগরিক সংগঠন সক্রিয়া হওয়ায় এ পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে ইউনিয়নগুলোতে এ খাতে গড়ে দুই থেকে আড়াই লাখ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। পূর্বে এ বরাদ্ধের হার ছিল শূণ্য। রাইট টু গ্রো প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পুরণে জাতিসংঘ ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত ও পরিপূর্ণ পুষ্টির বিশ্ব গড়তে চায়। এ ক্ষেত্রে পুষ্টিহার বৃদ্ধি, শিশু স্বাস্থ্যের উন্নতি জরুরী।
পরিসংখ্যান ব্যুরো তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে অক্টোবর পর্যন্ত ডুমুরিয়া উপজেলায় শূণ্য থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ছিল ২৬ হাজার ২৮৪জন। ২০১৯ সালের এখানে শিশু অপুষ্টি (খর্বকায়) হার ছিল ৪ দশমিক ৬৫ থেকে ১৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। জেলার কয়রা ও দিঘলিয়ায়ও এ চিত্র একই। তবে দাকোপ, পাইকগাছা, ফুলতলা ও বটিয়াঘাটায় ২৬ দশমিক ৪৬ থেকে ৩৫দশমিক ৫৮, রূপসা,তেরখাদা ও দিঘলিয়ায় এ হার ৩৫দশমিক ৫৯ থেকে ৪৭ শতাংশ।
ডুমুরিয়া বয়ারশিং গ্রামের উর্মিলা মন্ডল, তন্নী মন্ডল জানান, তাদের শিশুরা বড় হতে শুরু করলে পেটের পীড়া, জ্বর, সর্দিসহ নানা সমস্যায় ভুগতো। ওজনও কম ছিল। পুষ্টির বিষয়টি জানতে পেরে তারা উপকার পেয়েছেন। বাচ্চাদের বার বার ডাক্তারের কাছে নিতে হচ্ছে না।
আটালিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. রাজু গাজী বলেন, ইউনিয়ন পরিষদেরই শিশুদের নিয়মিত ওজন মাপা ও স্বাস্থ্য পরামর্শ পাচ্ছি। এতে এখন আর ডাক্তারের কাছে যেতে হয় না।
মাগুরখালী ইউনিয়নে আবু মুসা বলেন, ‘আমরাতো বাচ্চাদের বড় পেট দেখে বলতাম দারোগা হবে। ওটা যে অপুষ্টি সেটি বুঝতাম না। পুষ্টিকর্মীরাও নিয়মিত কাজ করেন। এতে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে।’
পুষ্টিকর্মী ছন্দা মল্লিক (২৮), কাজ করছেন আটালিয়া ইউনিয়নে। তিনি বলেন, ‘পড়াশুনা শেষ করে প্রয়োজনের জন্য চাকুরি ঢুকেছিলাম। পুষ্টির ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। গ্রামের মা-শিশুরা পরিবারের মানুষ হয়ে গেছেন। এখন আর এটি চাকুরি মনে হচ্ছে না। সামাজিক দায়িত্ব মনে করে কাজ করছি।’
রংপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সমরেশ মন্ডল বলেন, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিতে আগে খুব বেশী বরাদ্ধ ছিল না। এখন আমরা প্রতিবছর দেড় থেকে দুই লাখ টাকা দিচ্ছি। আগামীতে এটি আরো বৃদ্ধি করা হবে।’
রঘুনাথপুর ইউপি চেয়ারম্যান মনোজিৎ বালা বলেন, ওয়ার্ড পর্যায়ের নাগরিক কমিটি রয়েছে। তারা নিয়মিত কাজ করেন। বেসরকারি সংগঠনগুলোও পুষ্টি পরামর্শে সহযোগিতা করছে। শিশু ও স্বাস্থ্যকে বেশী গুরুত্ব দিয়ে আমরা বরাদ্দ বৃদ্ধি করছি।
আটালিয়া ইউপি চেয়ারম্যান শেখ হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘এক সময়ে স্বাস্থ্য. পুষ্টি নিয়ে পরিষদে তেমন বরাদ্দ ছিল না। এখন মানুষ সচেতন হয়েছেন, আমরাও দিন বরাদ্দ বৃদ্ধি করছি। নাগরিক সংগঠন ও পরিষদের স্থায়ী কমিটিগুলো সক্রিয় না হলে এটি সম্ভব হতো না।’
দ্যা হাঙ্গার প্রজেক্টের কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন, ডুমুরিয়ার চিত্র অন্যান্য উপজেলা থেকে ভিন্ন। এখানকার মানুষ সচেতন। জনপ্রতিনিধিরাও সমন্বয় করছেন। ফলে তারা সফল হচ্ছেন।
খুলনা গেজেট/কেডি